শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১২

ইলিয়াস আলীর দীর্ঘায়ু কামনা করি



গত বছর এলডিপির নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন, এই সরকার সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টিকবে না। তারপর যখন সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টিকেই গেল, তখন তিনি সরকারের আয়ু ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করলেন। না, তাতেও তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ফলল না। তারপর পরবর্তী মেয়াদ আগামী (মানে সামনের) বাজেট সেশনের আগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করলেন। আগামী বাজেট জুন মাসের ৭ তারিখে সংসদে পেশ হওয়ার কথা রয়েছে। এখন দেশের মানুষকে সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কর্নেল সাহেব একজন বিচক্ষণ মানুষ। ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়ার দক্ষিণহস্ত। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গ ছাড়েননি। একাধিকবার বলেছেন, তিনিই খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে এনেছেন। বিগত জোট সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান সঙ্গে কী-সব বিষয় নিয়ে তুমুল মতপার্থক্য হলো। বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করে নিজে এলডিপি নামের একটি নতুন দল বানালেন। সঙ্গে বিএনপির আরও কিছু মধ্যম সারির নেতাকে নিজ দলের পতাকাতলে সমবেত করলেন। ২০০৭ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোটের সঙ্গে অন্যদের মতো অলি আহমদও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের গোয়ার্তুমির কারণে সে নির্বাচনটি হতে পারেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগেও তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনা রাজি হননি। এখন মনে হচ্ছে, রাজি না হয়ে ভালোই করেছেন। নবম সংসদে এলডিপি মাত্র একটি আসনে জয়ী হয় এবং তিনি কর্নেল অলি আহমদ। এক দলের এক নেতা হয়েও তিনি একটি মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হন। তারপর এক দিন সস্ত্রীক খালেদা জিয়ার বাসভবনে গিয়ে ঘোষণা করলেন, এখন থেকে তিনি তাঁর সঙ্গে থাকবেন এবং সরকার পতন আন্দোলনে সহায়তা করবেন। জানামতে, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধানের খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের নজির এটিই প্রথম। সুতরাং বোঝা যায়, তিনি খালেদা জিয়ার দল ছাড়লেও তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক সব সময় ছিল। দল ছাড়ার পর তিনি খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান সম্পর্কে বেশ কিছু কড়া কথা বলেছিলেন। এসব নিছকই ছিল কথার কথা। কর্নেল সাহেবের ভবিষ্যদ্বাণী ফলবে কি না, তা দেখার জন্য দেশের মানুষকে আর মাস খানেক অপেক্ষা করতে হবে। তবে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর ‘অন্তর্ধান’ নিয়ে দেশে যে জমজমাট নাটক শুরু হয়েছে, তা অনেকেই গণতন্ত্রের জন্য একধরনের অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন এবং মনে করছেন, এই নাটকের পরিকল্পনা ও মহড়া অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে; কিন্তু ক্ষমতাসীন দল তা বুঝতে পারেনি। সময় থাকতে আওয়ামী লীগ অনেক কিছুই বুঝতে পারে না এবং তার জন্য শুধু দল নয়, দেশের মানুষকেও চড়া মূল্য দিতে হয়।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সিলেট বিএনপির সভাপতি ইলিয়াস আলী তাঁর বনানীর বাসার কাছ থেকে ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতের পর তাঁর গাড়ির চালকসহ গুম বা নিখোঁজ হলেন। এ পর্যন্ত তাঁর বা গাড়িচালকের কোনো খোঁজ মেলেনি। কারা তাঁকে গুম করেছে, তা-ও পরিষ্কার নয়। যদিও বিএনপি বলছে, তাঁকে সরকারি বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ইলিয়াস আলীর বাসায় গিয়ে বলে এসেছেন, ইলিয়াস আলী ভালো আছে এবং সুস্থ আছে। সরকার বলছে, ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ইলিয়াস আলী কেন, যেকোনো নাগরিকই গুম হওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। সব নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। আর ইলিয়াস আলী তো বিএনপির জন্য একজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ নেতা, তাঁর অতীত যা-ই হোক না কেন। এই গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ‘পিস্তল ইলিয়াস’ বলে সম্বোধন করলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল বেশ উত্তেজিত হয়ে বুধবার এক সভায় বলেছেন, ইলিয়াস আলী নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথের একজন লড়াকু সৈনিক ছিল। তিনি এরশাদকে উৎখাত করার জন্য পিস্তল হাতে নিয়েছিলেন। তিনি আরও বললেন, এক ইলিয়াস আলীর জন্য রোববার থেকে সারা বাংলায় আগুন জ্বলবে। তবে মির্জা বলেননি, কেন তাঁকে ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ১৯৯২ সালে ইলিয়াস আলী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মাত্র তিন মাসের মাথায় কেন খালেদা জিয়া ছাত্রদলের নির্বাচিত কমিটি ভেঙে দিতে বাধ্য হন, তা-ও কিন্তু বলেননি মির্জা ফখরুল। তিনি এও বলেননি, কেন খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ইলিয়াস আলী দুই বছর কারাবাস করেন। বোধগম্য কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে এই গুরুত্বপূর্ণ নেতার অনেক কীর্তির কথা বলা থেকে বিরত থাকলাম। সবকিছু বিস্তারিত লিখে আমি নিজে গুমের শিকার হতে চাই না। আমার মতো অভাজন গুম হলেও ইলিয়াস আলীকে নিয়ে দেশে যে রকম তোলপাড় হচ্ছে, তার কোনোটাই আমার জন্য হবে না।
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের শত্রু থাকাটা বিচিত্র কিছু নয়। এই শত্রু সামান্য স্বার্থের দ্বন্দ্বে সৃষ্টি হতে পারে অথবা প্রতিপক্ষ যদি কোনো কারণে অন্যজনের রাজনৈতিক উত্থানের বাধার কারণ হয়, তখন প্রতিপক্ষও শত্রু হয়ে যেতে পারে। কিংবা রাজনৈতিক মতদ্বৈধতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন এক পক্ষ অন্য পক্ষের শত্রু হয়ে যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কথা বাদই দিলাম, বিগত চারদলীয় জোটের শাসনামলে চট্টগ্রামের বিএনপির নেতা জামালউদ্দিন গুম হয়ে গেলেন। পরিবারের সবার সে কী আহাজারি। তাঁরা দেখা করলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে। লাভ হলো না কিছুই। তাঁরা বললেন, নিজ দলের লোকজনই জামালউদ্দিনকে গুম করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টারকে হত্যা করা হলো, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া সিলেটের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় নিহত হলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছোড়া অসংখ্য গ্রেনেডের হামলায় শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২২ জন নিহত হলেন। তারপর কী হলো? বিএনপি এক ইলিয়াস আলীর জন্য যেভাবে দেশ অচল করে দিল, তার ছিটেফোঁটাও তো আওয়ামী লীগ তখন করতে পারল না। সম্ভবত তাঁরা কেউই ইলিয়াস আলীর মতো তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না!
বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ইলিয়াস আলী অপরিহার্য, সে কারণে সবাই সমবেদনা জানাতে ইলিয়াস আলীর বাসায় ছুটে গেছেন। তাঁকে উদ্ধারের জন্য এক দিন এক দিন করে বিএনপি লাগাতার তিন দিন হরতাল আহ্বান করল। হরতাল শুরুর আগের দিন একজন ঘুমন্ত বাস-ড্রাইভার বদর আলীকে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারা হলো। পরদিন পিকেটারদের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে ক্যাব ড্রাইভার আবদুর রশিদ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। ইলিয়াস আলীর নিজ এলাকায় বিশ্বনাথে পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত হলেন। তাঁদের জন্য কেউ তেমন একটা উচ্চবাচ্য করল না। কারণ, তাঁরা কেউই ইলিয়াস আলীর মতো গুরুত্বপূর্ণ নন। তিন দিনের হরতালে লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর এইচএসসি পরীক্ষা তছনছ হলো। কারও কিন্তু এ ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই। বৃহস্পতিবার মির্জা সাহেব বলেছেন, তাঁরা হরতাল দিতে চান না, কিন্তু দিতে বাধ্য হয়েছেন; কারণ দেশের মানুষ নাকি হরতাল চায় এবং পছন্দ করে। এ ব্যাপারে সহকর্মী মুনতাসীর মামুনের একটা মন্তব্য মনে পড়ল। হরতালের তৃতীয় দিনে কারওয়ান বাজারে পিকেটাররা ভোরে একটি নতুন প্রাইভেট গাড়িতে আগুন দিলে মামুন ফোনে আমাকে জানালেন, মনে হয়, জনগণ বিএনপির হরতাল পছন্দ করেছে। কারণ, একজন রাস্তায় তার নতুন গাড়িটা বের করে পিকেটারদের কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগাতে দিয়েছে। তার সঙ্গে দ্বিমত করি কীভাবে? 
সবাই ইলিয়াস আলীর বাড়িতে সমবেদনা জানাতে ছুটে গেলেও একই পাড়ায় বসবাসরত খালেদা জিয়া কিন্তু যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। তিনি তাঁর ২৩ তারিখের সংবাদ সম্মেলনে ইলিয়াসের পরিবারকে তাঁর দপ্তরে হাজির থাকার ব্যবস্থা করেছেন। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী প্রথম দিকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে বেশ সহযোগিতা করলেও খালেদা জিয়ার সঙ্গে হরতালের দ্বিতীয় দিন তাঁর সাক্ষাতের পর থেকে চুপচাপ হয়ে গেছেন। খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি সরকারকে শনিবার পর্যন্ত সময় দিচ্ছেন ইলিয়াস আলীকে হাজির করার জন্য। তা করতে ব্যর্থ হলে রোববার থেকে নতুন এবং কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। কিন্তু তাঁর তর সইল না। ঠিক পরদিন ১৮ দলীয় মিত্রদের নিয়ে বিএনপি ঘোষণা করল, ইলিয়াস আলীবিহীন শনিবার পার হলেই পরের দুই দিন ফের হরতাল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ সাংবাদিকদের ডেকে জানালেন, সরকার ইলিয়াস আলীকে জীবিত উদ্ধারের সব চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে এবং তিনি আশা করছেন, এই নেতা দ্রুত উদ্ধার হবেন। না, যেহেতু জনগণ হরতাল পছন্দ করে, সেহেতু তা আগেভাগেই ঘোষণা করে দেওয়া ভালো। আসলে অনেকের মতে, ইলিয়াস আলী এখন বিরোধী দলের রাজনীতির জন্য একটি তুরুপের তাসের মতো। তাঁকে উদ্ধার করতে পারলে তখন বিএনপি কী নিয়ে রাজনীতি করবে? তাদের বলেছি, তারা নতুন একটা ইস্যু খুঁজে নেবে। অসুবিধা হবে না। 
সরকারকে বলি, এক ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার করতেই যদি এত সময়ক্ষেপণ হয়, তাহলে দেশের মানুষের তো হতাশ হওয়ারই কথা। তাঁকে তো ইতিমধ্যে হিরো বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন তাঁকে দ্রুত খুঁজে বের করুন। আর বিএনপি সরকার উৎখাতের নতুন কোনো পথ খুঁজতে থাকুক, কারণ বাজেট সেশন তো এসে গেল। কর্নেল সাহেব তো ওই পর্যন্তই এ যাত্রায় সময় বেঁধে দিয়েছেন। ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধানে আমি নিজেও তাঁর পরিবারের সঙ্গে সমব্যথিত, কারণ আমারও একটা পরিবার আছে। তবে অনেকের মতে, জীবিত ইলিয়াস আলীর চেয়ে মৃত ইলিয়াস বিরোধী দলের জন্য অনেক বেশি লাভজনক। আমি তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি।
 আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বুধবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১২

সুরঞ্জিতের বিদায় ও কালো বিড়াল



বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান এবং বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী মহাজোট সরকারের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ৫১ বছরের রাজনৈতিক জীবনের একটি বেদনাদায়ক সমাপ্তি হলো। তিনি সোমবার রেলমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করেছেন। যে ঘটনার প্রেক্ষাপটে এটি ঘটেছে তা শুধু ব্যক্তি সুরঞ্জিতের জন্যই বেদনাদায়ক নয়, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট সরকারের জন্যও বিব্রতকর এবং ঘটনাটির জন্য দলকে চড়া মূল্যও দিতে হতে পারে। পুরো বিষয়টির সমাপ্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়েছে। দেশের অবস্থা এমন হয়েছে যে ছোট থেকে বড় সমস্যা বা সংকট সবকিছুর জন্য প্রধানমন্ত্রীর দিকে সবাইকে তাকিয়ে থাকতে হয়। 
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যে কারণে পদত্যাগ করলেন, তা মোটামুটি দেশের সব মানুষ জানে। তিনি সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, বর্তমানে তিনি যে শুধু বিপদে আছেন তা-ই নয়, এই বিপদ গণতন্ত্রের জন্যও বটে। পাঠকদের একটু পেছনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। ১৯৮১ সালের কথা। তখন বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি। জিয়ার মৃত্যুর পর তিনি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বিচারপতি সাত্তার শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল ছিলেন। সরকারের অনেক কর্মকাণ্ড তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। ১৯৮২ সালের সম্ভবত জানুয়ারি মাসে যুববিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেমের সরকারি বাসভবন থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সন্ত্রাসী ইমদুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এর কদিন পরই ২৪ মার্চ এরশাদ বন্দুকের জোরে রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে টিভি ও বেতারে এক ভাষণ দিয়ে তাঁর পদক্ষেপ জায়েজ করার চেষ্টা করলেন এবং সবাইকে মনে করিয়ে দিতে ভুললেন না, যে সরকারের একজন মন্ত্রীর বাসা থেকে একজন বড় মাপের সন্ত্রাসীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে সে সরকারকে আর ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া যায় না। অতএব, তিনি ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ৯ এপ্রিল রাত ১১টায় রেলমন্ত্রীর সহকারী ব্যক্তিগত সচিব ওমর ফারুক তালুকদার ও রেলের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা ৭০ লাখ টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির হাতে তাদের সদর দপ্তর পিলখানায় ধরা পড়েন। এ সময় তাঁরা একটি মাইক্রোবাসে ছিলেন এবং তাঁদের সঙ্গে ছিলেন রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর ঢাকা বিভাগের কমান্ড্যান্ট এনামুল হক এবং গাড়িটি চালাচ্ছিলেন চালক আজম খান। 
৭০ লাখ টাকা (টাকার অঙ্ক নিয়ে একাধিক মত আছে), চারজন লোক, সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বাহিনী আর অনেকগুলো অমীমাংসিত প্রশ্ন। প্রথমত, টাকাগুলো কার? এত রাতে যাচ্ছিল কোথায়? বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর পিলখানায় সাধারণ মানুষ বা তাদের যানবাহন প্রবেশ সহজ নয়। সন্ধ্যার পর প্রধান ফটক বন্ধ থাকে। প্রয়োজনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা তা খোলেন। গাড়ির চালক আজম খান তাঁর গাড়ি নিয়ে এত সহজে সেখানে প্রবেশ করলেন কীভাবে? বলা হয়েছিল, ওই গাড়ির চারজনকেই বিজিবি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। চারজনকেই সকালে ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তিনজনের হদিস পাওয়া গেলেও চালকের এই অবধি কোনো হদিস মিলছে না। তিনি কোথায় গেলেন? রাত ১১টায় ঘটনার সূত্রপাত। এত দ্রুত সংবাদমাধ্যম কীভাবে খবর পেল? যে টাকার বস্তা নিয়ে এত তোলপাড়, সে টাকার বস্তা কার হেফাজতে আছে? অন্য কেউ যদি এ রকম একটি ঘটনায় আটক হতো তাকে বা তাদের কি এভাবে ছাড়া হতো? পরদিন রেলমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন। বললেন, বাংলা নতুন বছরে ঢাকা-সিলেট রুটে যে এক জোড়া নতুন ট্রেন চালু হওয়ার কথা, তা ওই দিন চালু হচ্ছে না, সেই সংবাদ জানানোর জন্য এই সংবাদ সম্মেলন।
আসলে কি তাই? সেটা তো একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েই জানানো যেত। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এত বোকা নন যে তিনি মনে করবেন, সাংবাদিকেরা আগের রাতের ৭০ লাখ টাকা সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন না। প্রশ্ন তাঁরা ঠিকই করেছেন। তিনি প্রথমে পুরো ঘটনা সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। পরে বললেন, ওই টাকা তাঁর সহকারী একান্ত সচিবের হতে পারে। বললেন, কারও কাছে ব্যক্তিগত ৭০ লাখ টাকা থাকতেই পারে। তা অবশ্যই পারে। কিন্তু রাত ১১টায় অত টাকা নিয়ে সাংসদের স্টিকার লাগানো গাড়িতে চারজন মানুষের ঘোরাফেরা যেকোনো বিচারেই সন্দেহজনক। পরদিন একান্ত সচিব ওমর ফারুক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ওই টাকা তাঁর শ্যালক লন্ডন থেকে পাঠিয়েছেন। কীভাবে পাঠালেন? বৈধ উপায়ে পাঠালে তার নিশ্চয় রেকর্ড থাকবে। আছে কি ও রকম কোনো রেকর্ড? আটক সবাই বলেছেন, তাঁরা গাড়ি নিয়ে রেলমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে যাচ্ছিলেন। রেলমন্ত্রী বলেছেন, তিনি রাত ১০টায় ঘুমিয়ে পড়েন। জিএম সাহেব বলেছেন, তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েই যাচ্ছিলেন। এখানে কেউ একজন অসত্য বলেছেন। তিনি কে? গোয়েন্দা বাহিনী তো মোবাইল ফোনের কল ট্রাক করে কললিস্ট বের করে থাকে। চেষ্টা করে দেখবে নাকি ওই চারজন কার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন? আবার মন্ত্রী মহোদয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ওমর ফারুক তাঁর বাসা মোহাম্মদপুরে যাচ্ছিলেন। কথাটা যদি সত্যও হয় তাহলে বাকি দুজন কোথায় যাচ্ছিলেন? তাঁরা কি একসঙ্গে ওমর ফারুকের বাসায় যাচ্ছিলেন? কেন এবং কী উদ্দেশ্যে? জিএম রেলের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা। তাঁর নিজের গাড়ির কী হলো? যে মাইক্রোবাসটিতে তাঁরা সে রাতে যাচ্ছিলেন, সেটি ওমর ফারুকের বলে সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। জিএম সাহেব তাঁর নিজের গাড়ি ব্যবহার না করে কেন মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিবের মতো একজন নিম্নপদস্থ কর্মকর্তার গাড়ি ব্যবহার করতে গেলেন? তা-ও আবার তাঁকে টেলিফোনে ডেকে নিয়ে তিনি গাড়িতে ওঠেন! 
জিএম ইউসুফ হোসেন মৃধা মাদারীপুরের ‘কৃতী সন্তান’। সৈয়দ আবুল হোসেন যখন যোগাযোগমন্ত্রী তখন তিনি পাঁচজনকে ডিঙিয়ে জিএম পদটিতে অভিষিক্ত হন। তিনি প্রশাসনের অন্য অনেকের মতো রাতারাতি আওয়ামী লীগ সমর্থক। রেলের সবাই বলে, মৃধা জেনারেল জিয়া আর বিএনপির একজন বড় অনুসারী। ঘটনাচক্রে সৈয়দ আবুল হোসেনের বাড়িও মাদারীপুর। বাংলাদেশের রাজনীতি, চাকরি, পদায়ন, পদোন্নতি ইত্যাদি বিষয়ে আঞ্চলিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। গোপালগঞ্জে যার জন্ম, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাদের অনেকের জন্য ঈদের চাঁদ ওঠে। সবাই নিজেকে একেকজন বঙ্গবন্ধু মনে করে। ২০০১ সালের প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু সাঈদের বাড়িও গোপালগঞ্জ ছিল। আবার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রচেষ্টাকারী মুফতি আবদুল হান্নানের বাড়িও কিন্তু গোপালগঞ্জে। আর যদি বিএনপি ক্ষমতায় থাকে, তাহলে দুটি জেলার মানুষের জন্য সব সময় ঈদের চাঁদ আকাশে থাকে—একটি বগুড়া আর অন্যটি ফেনী। 
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর ওই রাতের ৭০ লাখ টাকা (?) নিয়ে বিভিন্ন ইন্টারনেট ব্লগে কদিন ধরে বেশ রমরমা আসর বসছে। এই আসরে দুঃখজনকভাবে আবার সাম্প্রদায়িকতাও উঁকিঝুঁকি মারছে। কয়েকজন ইতিমধ্য তাঁকে ভারত চলে যেতে পরামর্শ দিয়েছে। কেউ কেউ মন্তব্য করেছে, এত দিনে বোঝা গেল কেন তাঁর মন্ত্রী হওয়ার জন্য এত খায়েশ ছিল। এখানে আবার ষড়যন্ত্রতত্ত্বও আছে, যার ইঙ্গিত ইতিমধ্যে দিয়েছি। আমার এক বন্ধু যে একজন ঘোরতর আওয়ামী লীগ সমর্থক, এই ঘটনার ফল বছরের শেষে মিলবে বলে আমাকে জানাল। তবে সে পরিষ্কার করে বলেনি সেটা কীভাবে ঘটবে। ১২ তারিখে শ্রীলঙ্কা থেকে প্রকাশিত শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ান এ বিষয়ে বেশ উপাদেয় মসলা দিয়ে এই ঘটনার সঙ্গে সরকারের অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির নাম দিয়ে একটি দীর্ঘ কাহিনি প্রকাশ করেছে। সেটি এখন অনেকগুলো ব্লগে বেশ ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছে। 
আসলে ওই টাকাগুলো যে অবৈধ তা মোটামুটি নিশ্চিত। তবে তদন্তে অন্য কিছুও বের হতে পারে। কথায় বলে, ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী।’ বাংলাদেশে বাণিজ্যের অভাব নেই। ভর্তি-বাণিজ্য, হলে সিট-বাণিজ্য, তদবির-বাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস-বাণিজ্য, জিম্মি-বাণিজ্য, মনোনয়ন-বাণিজ্য, পদায়ন-বাণিজ্য, পদোন্নতি-বাণিজ্য আর সবচেয়ে বড় বাণিজ্য নিয়োগ-বাণিজ্য। ১৫ কোটি মানুষের দেশে চাকরি এমনিতেই মহার্ঘ্য। সেখানে তো বাণিজ্যের পরিমাণ একটু বেশি হবেই। সরকারের এমন কোনো বিভাগ কি আছে, যেখানে বণিজ্য হয় না? গুলশান, বারিধারা, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা, বসুন্ধরা, প্রভৃতি অভিজাত এলাকায় যাঁদের বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট আছে, তাঁর মালিকানার ওপর যদি একটি জরিপ চালানো যেত, তাহলে বোঝা যেত বাংলাদেশে মৃধা বা ওমর ফারুকদের সংখ্যা কত। কাদের বাচ্চারা দেশের ভেতরে মাসে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বেতন দিয়ে স্কুলে পড়ে, কাদের ছেলেমেয়ে নিয়মিত বিদেশে লেখাপড়া করতে যায়, কারা ঈদে বা ছেলেমেয়ের বিয়ের বাজার করতে ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর যায়, কাদের মালয়েশিয়ায় বা দুবাইতে দ্বিতীয় আবাস আছে। এসব নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন করুক না একটা জরিপ। দেশের মানুষ দেখুক তাদের বুকের পাটা আছে। 
মানুষের যথার্থ প্রশ্ন ছিল, সুরঞ্জিত বিষয়ে জটিলতার সুরাহা কেমন করে হবে? আদৌ কি হবে? হলে তার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু থাকবে? তবে অধিকাংশ মানুষের মতো তিনি পা পিছলে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী বলার আগে নিজে পদ থেকে ইস্তফা দিলে কিছু সম্মান হলেও বাঁচত। তা হয়নি। বুঝতে হবে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের রাজনীতির একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন, নিজের ভুলে তাঁর পতন হয়েছে। রাজনীতিতে এমনটি হওয়া বিচিত্র নয়। তবে দেশের মানুষ দেখতে চায় এই টাকা-রহস্যের সঠিক সমাধান এবং এর সঙ্গে যারা জড়িত, তারা যেন কোনো অবস্থাতেই ছাড়া না পায়। মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কালো বিড়াল খুঁজছিলেন। ঘটনাচক্রে তিনি নিজেই যেন হয়ে গেলেন সেই কালো বিড়াল। তার পরও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে অভিনন্দন যে তিনি পদত্যাগ করার মতো সাহস দেখিয়েছেন। আর বিএনপির এই ঘটনায় উল্লসিত হওয়ার কারণ নেই, কারণ তাদের আমলের দুর্নীতির কথা এখনো মানুষ ভুলে যায়নি। 
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।