আবদুল মান্নান
শুরুতে বলে নিই, আমার এই লেখা বিশ্বব্যাংক-পদ্মা সেতু বিতর্কে সরকারের পক্ষে কোনো সাফাই গাওয়ার জন্য নয়। আর সরকারের পক্ষে সাফাই গাইলেও তা কেউ শুনবে না। কারণ, বিশ্বব্যাংকের ঢোলের আওয়াজ অনেক বড় এবং সে ঢোলে যখন বিশ্বব্যাংক বাড়ি দেয়, তখন তা এ দেশের মানুষ অনেক বেশি শোনে। এ দেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের অনেকেই সঠিকভাবে জানেন না বিশ্বব্যাংক আসলে কাদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং কোন কোন দেশ তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
বাংলাদেশের বহুপ্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু নির্মাণের পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির চেষ্টা হয়েছে—এ অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবে না বলে সরকারকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তারা এ দুঃসংবাদটি দিয়েছে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের এ ব্যাপারে চুক্তি হওয়ার ১৪ মাস পর। ফলে সরকারের তো বটেই, দেশের ভাবমূর্তিরও বড় ক্ষতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের যে অর্থ থেকে আপাতত বাংলাদেশ বঞ্চিত হলো, তা সহজ শর্তে ঋণ ছিল। একসময় দেশের জনগণকেই এই অর্থ সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হতো। পুরো বিষয় নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে বেশ হইচই হচ্ছে। বিরোধীদলীয় নেতা এই ‘অপরাধ’-এর কারণে সরকারেরই পদত্যাগ দাবি করেছেন। এটিও একটি নজিরবিহীন ঘটনা। পাশের দেশ ভারতে এমন একটি ঘটনা ঘটলে বিরোধী দল আর সরকারি দল একসঙ্গে বসে একটি কর্মপন্থা ঠিক করার চেষ্টা করত। ঠিক একই অজুহাতে বেগম জিয়ার আগের সরকারের আমলে বিশ্বব্যাংক একাধিক প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছিল; কিন্তু তা নিয়ে তেমন হইচই হয়নি। কারণ, সেসব প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের দেয় অর্থের পরিমাণ অনেক কম ছিল। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, বেগম জিয়া ও তাঁদের সভা পারিষদেরা কয়েক দিন ধরে বলে আসছেন, তাঁরা ক্ষমতায় গেলে একটি নয় দুটি পদ্মা সেতু বানাবেন। রাজনীতিতে বাগাড়ম্বর বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়, তবে তারও একটা সীমা থাকা উচিত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জেনারেল জিয়া, বিচারপতি সাত্তার এবং বেগম জিয়া বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ১৭ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তাঁরা কেন পদ্মার ওপর সেতু বানানোর চিন্তা করেননি, তা জনগণ জানে না। আর পদ্মার ওপর দুটি সেতুর আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, তা অর্থনৈতিক ও কারিগরি সমীক্ষার ব্যাপার। যাক সেসব কথা।
পদ্মার ওপর একটা সেতু হওয়ার প্রয়োজন আছে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছিল সেই আশির দশক থেকে। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে পদ্মা সেতু কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এই সেতুর মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯০ কোটি ডলার, যার মধ্যে ১২০ কোটি ডলার জোগান দিত বিশ্বব্যাংক। বাকিটা আসত এডিবি (৬১ দশমিক ৫ কোটি), জাইকা (৪১ দশমিক ৫ কোটি) ও আইডিবি (১৪ কোটি) থেকে। বাংলাদেশের নিজস্ব তহবিল থেকেও এই প্রকল্পের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ (৫৩ কোটি) আসত, যার একটি বড় অংশ ইতিমধ্যে জমি অধিগ্রহণ, মাটি ভরাট প্রভৃতি কাজে খরচ হয়েছে। এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে এ ব্যাপারে সবার আগে আগ্রহ দেখায় এডিবি ও জাইকা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্পটিতে বিশ্বের বড় অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসঙ্গে করার মধ্যে বর্তমান সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, যা এখন কেউ তেমন বলে না। এটাও ঠিক, এত বড় একটি প্রকল্প এককভাবে বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশের একার পক্ষে এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। যেটি সম্ভব তা হচ্ছে, অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনে নিজস্ব উৎস থেকে সর্বাধিক অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করা, যেটি বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর ক্ষেত্রে বেশ ভালোভাবেই করেছে। সেই সেতু শুরু হয়েছিল জনগণ থেকে বিভিন্ন ধরনের সারচার্জের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। বাকি অর্থলগ্নিকারী ও দাতা প্রতিষ্ঠান পরে এসেছিল। উন্নয়নশীল ও গরিব দেশগুলো অনেক সময় নিজেরাই আপদ ডেকে আনে, যখন তারা বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের শরণাপন্ন হয়।
১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তাত্ত্বিকভাবে দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হলেও এদের পক্ষে কখনো সম্ভব নয় যুক্তরাষ্ট্রের কথার বাইরে গিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া। অথচ উভয়েরই সদস্যরাষ্ট্রের সংখ্যা ১৮৮। বিশ্বব্যাংকের প্রধান সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আর আইএমএফের প্রধান একজন ইউরোপিয়ান, যদিও তাঁর নিয়োগেও অলিখিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সায় থাকতে হয়। আর এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের ক্ষেত্রেই পশ্চিমা দেশগুলোর ইহুদি (জায়নিস্ট) লবির একটা বড় ভূমিকা থাকে। একটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির একজন সিনিয়র অধ্যাপক যুক্তরাষ্ট্র থেকে সম্প্রতি আমাকে ইন্টারনেটে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। তিনি একসময় বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আঙ্কটাডের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। তিনি লিখেছেন, তাদের সঙ্গে কাজ না করলে বাইরে থেকে বোঝা যাবে না, এসব সংস্থার ভেতরে কত অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়।
বিশ্বব্যাংক কোনো দেশের প্রকল্পে অর্থায়ন করলে প্রকল্প নির্ধারণ থেকে শুরু করে প্রকল্প বাছাই, ঠিকাদার ও পরামর্শক নিয়োগ—সব নিজেদের ইচ্ছামতো করতে চায় এবং তা করতে চাওয়ায় নিজেদের স্বার্থকেই সব সময় প্রাধান্য দেয়, ঋণগ্রহীতা দেশের স্বার্থ তখন গৌণ হয়ে পড়ে। যেহেতু আমি নিজে এমন একটা বড় প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, সেহেতু এই মন্তব্য অভিজ্ঞতাপ্রসূত। এককথায়, বিশ্বব্যাংক সুযোগ পেলে সব দেশেই দাদাগিরি করতে কুণ্ঠিত হয় না। এমন একটি মন্তব্য সম্প্রতি টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান করেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে হয়।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ শুধু একটি মন্তব্যের জন্য তাঁর পদ থেকে অপসারিত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, যেসব দেশ বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করেছে বা তাদের পরামর্শে বেশি কান দিয়েছে, সেসব দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে, সরকারের পতন হয়েছে এবং রাজপথে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে। তিনি বিশ্বব্যাংক ছাড়ার আগে সঙ্গে করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্রের কপি নিয়ে যান। সেসব দলিলপত্রে অনেক দেশের কথা উল্লেখ আছে, যেগুলো বিশ্বব্যাংকের পরামর্শের কারণে প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি আর্জেন্টিনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, আশির দশকের শেষের দিক থেকে শুরু করে উল্লিখিত দুটি সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী সে দেশের সরকার জনসেবামূলক (যেমন, পানীয় জল সরবরাহ) বেসরকারীকরণসহ বিভিন্ন খাত থেকে ভর্তুকি কমানো শুরু করে, জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়াতে থাকে এবং অবশেষে দেশটিতে শুরু হয় চরম রাজনৈতিক অসন্তোষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা। সে দেশে এ সময় পাঁচ সপ্তাহে ছয়জন রাষ্ট্রপতি পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। স্টিগলিজ আরও লিখেছেন, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করার জন্য সে দেশের অনেক রাজনীতিবিদকে ভারী রকমের উৎকোচ প্রদান করে। যেসব দেশের সরকার দুর্বল, সেসব দেশ অনেক সময় বাধ্য হয় বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের নানা গণবিরোধী পরামর্শ মেনে নিতে। যাদের মেরুদণ্ড শক্ত, তারা এসব অযাচিত পরামর্শের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারে। ১৯৭৬ সালে বিশ্বব্যাংক ভারতের সুবর্ণরেখা (বিহার-ওডিশা) নদীতে একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে অর্থায়ন করেছিল। প্রকল্পের মাঝপথে তারা সরকারকে নতুন নতুন শর্ত দেওয়া শুরু করে। এতে বিরক্ত হয়ে ভারত সরকার বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দেয়। সরকারের এই সিদ্ধান্ত সে দেশের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দল একযোগে সমর্থন করে। সব স্বার্থের আগে দেশের স্বার্থ। পরে বিশ্বব্যাংক নিজ গরজেই অর্থায়নে ফিরে আসে। আসলে বিশ্বব্যাংক হচ্ছে একটি বড় মহাজন। টাকা ধার দেওয়াই তাদের কাজ-কারবার। ২০০৪-০৫ সালে বিশ্বের অন্যতম তেলসমৃদ্ধ দেশ ভেনেজুয়েলা দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের অতিরিক্ত পরামর্শ শুনে। এরপর সে দেশের প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজ এ দুটি সংস্থা থেকে নিজ দেশকে প্রত্যাহার করে নেন। চীন একটি বড় দাতাদেশ হয়েও বিশ্বব্যাংক থেকে অর্থ ধার করে, তবে তাদের শর্তে। বাংলাদেশের পক্ষে এমন শক্ত অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়, নিলে যদি বিশ্বব্যাংকের তা পছন্দ না হয় এবং তারা কোনো প্রকল্পের অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় (যেমন, পদ্মা সেতু), তখন সবকিছুর আগে বিরোধী দলগুলো বুঝে হোক আর না বুঝে হোক ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ দাবি করবে আর সরকারের দিকে সবাই তির ছুড়বে।
সামান্য আলোচনা করতে চাই পদ্মা সেতুর বিষয়ে। শ্রদ্ধেয় ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী পদ্মা সেতু প্রকল্প-বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২ জুলাইসমকাল-এ তাঁর একটি চমৎকার বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সেখানে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, বিশ্বব্যাংক কীভাবে একটি ভুয়া চীনা কোম্পানিকে (সিআরসিসি) প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও পরামর্শক হিসেবে এই প্রকল্পে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে এবং সেই কোম্পানি কেমন সব জালিয়াতি করেছে। সেই কোম্পানিকে গেলাতে ব্যর্থ হয়ে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ওপর বেশ ক্ষুব্ধ হয় এবং পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিলে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে বিশ্বাস। দুর্নীতির অভিযোগটা হয়তো একটি অজুহাত। বাকি বিষয়গুলো সম্পর্কে বলা থেকে বিরত থাকলাম। কারণ, এসব বিষয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। তবে সরকারের এখন যা করা উচিত, বিশ্বব্যাংক সরকারকে যেসব চিঠিপত্র লিখেছে, তা উন্মুক্ত করে দেওয়া এবং যে অভিযোগ নিয়ে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে অপমান করেছে, তার একটি সুষ্ঠু (বিচার বিভাগীয় বা সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে) তদন্ত করা। আর পদ্মার ওপর সেতু হবে, এটি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদা ছিল। যদি সেই ওয়াদা শেষ পর্যন্ত পূরণ না করা যায়, তাও সব তথ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকেই জাতির সামনে তুলে ধরা উচিত। কারণ, তাঁকে এখনো মানুষ বিশ্বাস করে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম দেশ। দেশের স্বার্থে বিশ্বব্যাংকের সব দাবি পূরণ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। আবার এটাও ঠিক, জাতীয় স্বার্থে কোনো ব্যক্তিকেই অপরিহার্য ভাবা উচিত নয়।
সব শেষে একটি তত্ত্ব দিয়ে লেখাটি শেষ করি। এই পদ্মা সেতু বিষয়টি পুঁজি করে সামনের নির্বাচনে বিরোধী দল বিজয়ী হতে চাইবে। তাদের পিঠে চড়ে আবার জঙ্গিবাদের রমরমা উত্থান হবে। সেই সুযোগ পশ্চিমা দুনিয়া বাংলাদেশে ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ রপ্তানি করতে উদ্যোগী হবে। আসলে সবকিছুই মনে হয় পূর্বপরিকল্পিত।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের বহুপ্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু নির্মাণের পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির চেষ্টা হয়েছে—এ অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবে না বলে সরকারকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তারা এ দুঃসংবাদটি দিয়েছে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের এ ব্যাপারে চুক্তি হওয়ার ১৪ মাস পর। ফলে সরকারের তো বটেই, দেশের ভাবমূর্তিরও বড় ক্ষতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের যে অর্থ থেকে আপাতত বাংলাদেশ বঞ্চিত হলো, তা সহজ শর্তে ঋণ ছিল। একসময় দেশের জনগণকেই এই অর্থ সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হতো। পুরো বিষয় নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে বেশ হইচই হচ্ছে। বিরোধীদলীয় নেতা এই ‘অপরাধ’-এর কারণে সরকারেরই পদত্যাগ দাবি করেছেন। এটিও একটি নজিরবিহীন ঘটনা। পাশের দেশ ভারতে এমন একটি ঘটনা ঘটলে বিরোধী দল আর সরকারি দল একসঙ্গে বসে একটি কর্মপন্থা ঠিক করার চেষ্টা করত। ঠিক একই অজুহাতে বেগম জিয়ার আগের সরকারের আমলে বিশ্বব্যাংক একাধিক প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছিল; কিন্তু তা নিয়ে তেমন হইচই হয়নি। কারণ, সেসব প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের দেয় অর্থের পরিমাণ অনেক কম ছিল। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, বেগম জিয়া ও তাঁদের সভা পারিষদেরা কয়েক দিন ধরে বলে আসছেন, তাঁরা ক্ষমতায় গেলে একটি নয় দুটি পদ্মা সেতু বানাবেন। রাজনীতিতে বাগাড়ম্বর বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়, তবে তারও একটা সীমা থাকা উচিত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জেনারেল জিয়া, বিচারপতি সাত্তার এবং বেগম জিয়া বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ১৭ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তাঁরা কেন পদ্মার ওপর সেতু বানানোর চিন্তা করেননি, তা জনগণ জানে না। আর পদ্মার ওপর দুটি সেতুর আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, তা অর্থনৈতিক ও কারিগরি সমীক্ষার ব্যাপার। যাক সেসব কথা।
পদ্মার ওপর একটা সেতু হওয়ার প্রয়োজন আছে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছিল সেই আশির দশক থেকে। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে পদ্মা সেতু কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এই সেতুর মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯০ কোটি ডলার, যার মধ্যে ১২০ কোটি ডলার জোগান দিত বিশ্বব্যাংক। বাকিটা আসত এডিবি (৬১ দশমিক ৫ কোটি), জাইকা (৪১ দশমিক ৫ কোটি) ও আইডিবি (১৪ কোটি) থেকে। বাংলাদেশের নিজস্ব তহবিল থেকেও এই প্রকল্পের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ (৫৩ কোটি) আসত, যার একটি বড় অংশ ইতিমধ্যে জমি অধিগ্রহণ, মাটি ভরাট প্রভৃতি কাজে খরচ হয়েছে। এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে এ ব্যাপারে সবার আগে আগ্রহ দেখায় এডিবি ও জাইকা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্পটিতে বিশ্বের বড় অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসঙ্গে করার মধ্যে বর্তমান সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, যা এখন কেউ তেমন বলে না। এটাও ঠিক, এত বড় একটি প্রকল্প এককভাবে বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশের একার পক্ষে এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। যেটি সম্ভব তা হচ্ছে, অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনে নিজস্ব উৎস থেকে সর্বাধিক অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করা, যেটি বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর ক্ষেত্রে বেশ ভালোভাবেই করেছে। সেই সেতু শুরু হয়েছিল জনগণ থেকে বিভিন্ন ধরনের সারচার্জের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। বাকি অর্থলগ্নিকারী ও দাতা প্রতিষ্ঠান পরে এসেছিল। উন্নয়নশীল ও গরিব দেশগুলো অনেক সময় নিজেরাই আপদ ডেকে আনে, যখন তারা বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের শরণাপন্ন হয়।
১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তাত্ত্বিকভাবে দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হলেও এদের পক্ষে কখনো সম্ভব নয় যুক্তরাষ্ট্রের কথার বাইরে গিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া। অথচ উভয়েরই সদস্যরাষ্ট্রের সংখ্যা ১৮৮। বিশ্বব্যাংকের প্রধান সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আর আইএমএফের প্রধান একজন ইউরোপিয়ান, যদিও তাঁর নিয়োগেও অলিখিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সায় থাকতে হয়। আর এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের ক্ষেত্রেই পশ্চিমা দেশগুলোর ইহুদি (জায়নিস্ট) লবির একটা বড় ভূমিকা থাকে। একটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির একজন সিনিয়র অধ্যাপক যুক্তরাষ্ট্র থেকে সম্প্রতি আমাকে ইন্টারনেটে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। তিনি একসময় বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আঙ্কটাডের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। তিনি লিখেছেন, তাদের সঙ্গে কাজ না করলে বাইরে থেকে বোঝা যাবে না, এসব সংস্থার ভেতরে কত অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়।
বিশ্বব্যাংক কোনো দেশের প্রকল্পে অর্থায়ন করলে প্রকল্প নির্ধারণ থেকে শুরু করে প্রকল্প বাছাই, ঠিকাদার ও পরামর্শক নিয়োগ—সব নিজেদের ইচ্ছামতো করতে চায় এবং তা করতে চাওয়ায় নিজেদের স্বার্থকেই সব সময় প্রাধান্য দেয়, ঋণগ্রহীতা দেশের স্বার্থ তখন গৌণ হয়ে পড়ে। যেহেতু আমি নিজে এমন একটা বড় প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, সেহেতু এই মন্তব্য অভিজ্ঞতাপ্রসূত। এককথায়, বিশ্বব্যাংক সুযোগ পেলে সব দেশেই দাদাগিরি করতে কুণ্ঠিত হয় না। এমন একটি মন্তব্য সম্প্রতি টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান করেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে হয়।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ শুধু একটি মন্তব্যের জন্য তাঁর পদ থেকে অপসারিত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, যেসব দেশ বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করেছে বা তাদের পরামর্শে বেশি কান দিয়েছে, সেসব দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে, সরকারের পতন হয়েছে এবং রাজপথে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে। তিনি বিশ্বব্যাংক ছাড়ার আগে সঙ্গে করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্রের কপি নিয়ে যান। সেসব দলিলপত্রে অনেক দেশের কথা উল্লেখ আছে, যেগুলো বিশ্বব্যাংকের পরামর্শের কারণে প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি আর্জেন্টিনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, আশির দশকের শেষের দিক থেকে শুরু করে উল্লিখিত দুটি সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী সে দেশের সরকার জনসেবামূলক (যেমন, পানীয় জল সরবরাহ) বেসরকারীকরণসহ বিভিন্ন খাত থেকে ভর্তুকি কমানো শুরু করে, জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়াতে থাকে এবং অবশেষে দেশটিতে শুরু হয় চরম রাজনৈতিক অসন্তোষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা। সে দেশে এ সময় পাঁচ সপ্তাহে ছয়জন রাষ্ট্রপতি পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। স্টিগলিজ আরও লিখেছেন, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করার জন্য সে দেশের অনেক রাজনীতিবিদকে ভারী রকমের উৎকোচ প্রদান করে। যেসব দেশের সরকার দুর্বল, সেসব দেশ অনেক সময় বাধ্য হয় বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের নানা গণবিরোধী পরামর্শ মেনে নিতে। যাদের মেরুদণ্ড শক্ত, তারা এসব অযাচিত পরামর্শের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারে। ১৯৭৬ সালে বিশ্বব্যাংক ভারতের সুবর্ণরেখা (বিহার-ওডিশা) নদীতে একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে অর্থায়ন করেছিল। প্রকল্পের মাঝপথে তারা সরকারকে নতুন নতুন শর্ত দেওয়া শুরু করে। এতে বিরক্ত হয়ে ভারত সরকার বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দেয়। সরকারের এই সিদ্ধান্ত সে দেশের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দল একযোগে সমর্থন করে। সব স্বার্থের আগে দেশের স্বার্থ। পরে বিশ্বব্যাংক নিজ গরজেই অর্থায়নে ফিরে আসে। আসলে বিশ্বব্যাংক হচ্ছে একটি বড় মহাজন। টাকা ধার দেওয়াই তাদের কাজ-কারবার। ২০০৪-০৫ সালে বিশ্বের অন্যতম তেলসমৃদ্ধ দেশ ভেনেজুয়েলা দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের অতিরিক্ত পরামর্শ শুনে। এরপর সে দেশের প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজ এ দুটি সংস্থা থেকে নিজ দেশকে প্রত্যাহার করে নেন। চীন একটি বড় দাতাদেশ হয়েও বিশ্বব্যাংক থেকে অর্থ ধার করে, তবে তাদের শর্তে। বাংলাদেশের পক্ষে এমন শক্ত অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়, নিলে যদি বিশ্বব্যাংকের তা পছন্দ না হয় এবং তারা কোনো প্রকল্পের অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় (যেমন, পদ্মা সেতু), তখন সবকিছুর আগে বিরোধী দলগুলো বুঝে হোক আর না বুঝে হোক ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ দাবি করবে আর সরকারের দিকে সবাই তির ছুড়বে।
সামান্য আলোচনা করতে চাই পদ্মা সেতুর বিষয়ে। শ্রদ্ধেয় ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী পদ্মা সেতু প্রকল্প-বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২ জুলাইসমকাল-এ তাঁর একটি চমৎকার বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সেখানে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, বিশ্বব্যাংক কীভাবে একটি ভুয়া চীনা কোম্পানিকে (সিআরসিসি) প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও পরামর্শক হিসেবে এই প্রকল্পে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে এবং সেই কোম্পানি কেমন সব জালিয়াতি করেছে। সেই কোম্পানিকে গেলাতে ব্যর্থ হয়ে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ওপর বেশ ক্ষুব্ধ হয় এবং পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিলে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে বিশ্বাস। দুর্নীতির অভিযোগটা হয়তো একটি অজুহাত। বাকি বিষয়গুলো সম্পর্কে বলা থেকে বিরত থাকলাম। কারণ, এসব বিষয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। তবে সরকারের এখন যা করা উচিত, বিশ্বব্যাংক সরকারকে যেসব চিঠিপত্র লিখেছে, তা উন্মুক্ত করে দেওয়া এবং যে অভিযোগ নিয়ে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে অপমান করেছে, তার একটি সুষ্ঠু (বিচার বিভাগীয় বা সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে) তদন্ত করা। আর পদ্মার ওপর সেতু হবে, এটি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদা ছিল। যদি সেই ওয়াদা শেষ পর্যন্ত পূরণ না করা যায়, তাও সব তথ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকেই জাতির সামনে তুলে ধরা উচিত। কারণ, তাঁকে এখনো মানুষ বিশ্বাস করে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম দেশ। দেশের স্বার্থে বিশ্বব্যাংকের সব দাবি পূরণ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। আবার এটাও ঠিক, জাতীয় স্বার্থে কোনো ব্যক্তিকেই অপরিহার্য ভাবা উচিত নয়।
সব শেষে একটি তত্ত্ব দিয়ে লেখাটি শেষ করি। এই পদ্মা সেতু বিষয়টি পুঁজি করে সামনের নির্বাচনে বিরোধী দল বিজয়ী হতে চাইবে। তাদের পিঠে চড়ে আবার জঙ্গিবাদের রমরমা উত্থান হবে। সেই সুযোগ পশ্চিমা দুনিয়া বাংলাদেশে ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ রপ্তানি করতে উদ্যোগী হবে। আসলে সবকিছুই মনে হয় পূর্বপরিকল্পিত।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন