সোমবার, ৭ মে, ২০১২

উপাচার্যকে সরালেই সব সমস্যার সমাধান হবে না





আগামী অগাস্ট মাসে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আমার শিক্ষকতা জীবনের ৩৯ বছর অতিক্রান্ত হবে এবং এই লেখার যে যৎসামান্য বক্তব্য তা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই। শিক্ষকতার এই দীর্ঘ জীবনে আমার সুযোগ হয়েছে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যতগুলো বিধিবদ্ধ পর্ষদ আছে তার সবগুলোতে নির্বাচিত বা মনোনীত সদস্য হিসেবে কাজ করার। 
১৯৯৬ সালের ৬ নভেম্বর মাননীয় চ্যান্সেলর (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) আমাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালে আমাকে সে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। আমার নির্দিষ্ট মেয়াদ ছিল না, ছিল চলতি দায়িত্ব। উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আমি নিয়মিত ক্লাসও নিয়েছি। আমাকে অপসারণের জন্য কোনো শিক্ষক বা তেমন কোনো ছাত্রসংগঠন আন্দোলন করেনি। তবে আমার কিছু অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন আমাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য শেষের দিকে এসে বিভিন্ন মহলে দেনদরবার করেছেন এবং দৈনন্দিন কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছেন, চ্যান্সেলরের কাছে আমার বিরুদ্ধে চিঠি চালাচালি করেছেন। দায়িত্ব পালনকালে চেষ্টা আমি করেছিলাম সিনেট কর্তৃক উপাচার্যের প্যানেল প্রস্তুত করার, কিন্তু তা সম্ভব হলো না। কারণ এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে দুজন শিক্ষকের একটি মামলা ছিল। মামলাটি ১৯ বার আদালতে তালিকাভুক্ত হলেও শুনানি হয় শেষবার। এর পরপরই আমি উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে পদক্ষেপ নিলে সেই সব ব্যক্তিই আবার এই প্যানেল নির্বাচনের বিরোধিতা করা শুরু করেন, যাঁরা আগে প্যানেল নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। তাঁদের এই স্ববিরোধিতার কারণ ছিল, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যাঁকে বা যাঁদের সামনে নিয়ে তাঁদের এত দিনের আস্ফাালন, তাঁদের পক্ষে এই সিনেট কর্তৃক প্যানেলে নির্বাচিত হওয়া সম্ভব ছিল না। এরপর এক যুগ পার হয়েছে কিন্তু আজ অবধি আমার ওই সব সহকর্মী বন্ধু সিনেট কর্তৃক প্যানেল নির্বাচনের আর দাবি তোলেননি। প্রায়শ আমি বিখ্যাত গজল গায়ক অনুপ জালোটার একটা গজল শুনি, যার প্রথম কয়েকটি লাইন হচ্ছে ‘খঞ্জরসে না কারো বাত, না তালোয়রসে পুছো, মাই কতল হুয়ে কাইসে ও মেরে ইয়ারসে পুচে।’ (আমার হত্যা কী করে হলো তার জন্য ছুরি বা তলোয়ারের কাছে প্রশ্ন করো না, মৃত্যু আমার কেমন করে হলো তা আমার বন্ধুর কাছে জানতে চাও।)
লেখার শুরুতে এত গৌড়চন্দ্রিকা দেওয়ার কারণ বর্তমানে একসঙ্গে দেশের বেশ কটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎ করে ছাত্র-শিক্ষক এবং শিক্ষক-শিক্ষকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অশান্ত হয়ে ওঠা বিষয়ে কিছু কথা আলোচনা করার জন্য। প্রথমে বলে রাখি, সম্প্রতি যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ সময় ধরে অচল হয়ে থাকার পর প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা আবার সচল হচ্ছে, এর জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ। তবে একটি কথা না বললেই নয়। প্রথমে সব সমস্যার সমাধান প্রধানমন্ত্রীকে কেন করতে হবে তা বুঝতে পারি না। বর্তমান মন্ত্রিসভায় যে কজন সফল মন্ত্রী আছেন তাঁর মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী অন্যতম। তাঁর আছে একজন দক্ষ শিক্ষাসচিব। তাঁরা কি এই সমস্যার সমাধান করতে পারতেন না? দ্বিতীয়ত যে পন্থায় এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার আপাতত সমাধান হবে বলে মনে করা হচ্ছে আসলে কি তাই? সার্বিক বিচারে মনে হয় এই আপাতত সমাধান শুরু করে দিতে পারে অনুরূপ সমস্যা অন্য আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে। একজন উপাচার্যকে সরাতে হলে কিছু শিক্ষককে একসঙ্গে হতে হবে, ক্লাস বর্জন করতে হবে, উপাচার্যকে সত্য হোক আর অসত্য হোক সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে তাঁর বাড়ির দুয়ারে অথবা দপ্তরের সামনে শামিয়ানা টানিয়ে ধরনা দিয়ে বসে থাকতে হবে, তারপর এক দিন তাঁদের প্রধানমন্ত্রী তাঁর দপ্তরে বা বাসায় ডেকে নেবেন, তাঁদের দাবিগুলো ধৈর্যসহকারে শুনবেন এবং সব শেষে আশ্বাস দেবেন তিনি চ্যান্সেলরকে বিষয়গুলো জানাবেন এবং তিনি সেভাবে ব্যবস্থা নেবেন অর্থাৎ উপাচার্যকে সরিয়ে আরেকজনকে নিয়োগ দেবেন। সবাইকে বলি, পরের জনের অবস্থাও যে আগের জনের মতো হবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? চ্যান্সেলরকে একটা বিনীত অনুরোধ করতে চাই। যাঁরা একজন উপাচার্যকে সরাতে আন্দোলন করেন পরবর্তী উপাচার্য তাঁদের মধ্য থেকেই একজনকে করা হোক। এরপর যখন কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক যদি তাঁর বিভাগীয় প্রধানকে মানি না বলে তাঁর বাড়ির সামনে শামিয়ান টানান তখন কী হবে?
সংবাদপত্র খুললেই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ’অনিয়মের’ কথা শোনা যায়। যাঁরা এসব সংবাদ তৈরি করেন তাঁদের অনেকেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে চলে সেসব আইন-কানুন সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখেন না। প্রায়ই ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের কথা বলা হয়। দেশের ৩৩-৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আইন বলবৎ আছে। বাকিগুলোর উপাচার্য নিয়োগ একান্তভাবে চ্যান্সেলরের। অনেকে মনে করেন, নির্বাচিত উপাচার্য থাকলে সব সমস্যার সমাধান হবে। তাঁদের কাছে একটা প্রশ্ন করকে চাই, ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট তিনজন উপাচার্যের প্যানেল নির্বাচিত করেছিল। তার মধ্যে যাঁকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তিনি সর্বোচ্চ একাত্তর ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর মতো পণ্ডিত ব্যক্তি তখনো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি ছিল না, এখনো নেই। সেই উপাচার্যকে ১৯৯১ সালে বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে একটি ছাত্র সংগঠন ও কিছু শিক্ষকের দাবির মুখে ১৮৯৭ সালের একটি আইনের বলে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এরশাদের পতন হলে ছাত্র-শিক্ষকদের একটি বিজয় র‌্যালিতে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন ‘একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীরা নব্বইয়ে বিপ্লবী সেজেছে, তাদের কাছ হতে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়কে অচল করেছে, উপাচার্যকে সপরিবারে তাঁর সরকারি বাসভবনকে সাব জেল ঘোষণা করে গ্যাস-বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন রেখে ১২ দিন বন্দী করে রেখেছে। একপর্যায়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বদরুদ্দোজা চৌধুরী উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করলেন, উপাচার্যকে বললেন, ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী পদত্যাগ করতে। তা করতে তিনি অস্বীকার করলেন। শিক্ষকেরা ছাত্রদের অবরোধ ভেঙে ক্লাস নিতে গেলে ধর্মঘটী ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাঁদের ওপর হামলা করে অনেক বিশিষ্ট শিক্ষককে রক্তাক্ত করে, মেধাবী ছাত্র ফারুকউজ্জামান ফারুককে হত্যা করে। এদের অনেকেই এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পরে শিক্ষকেরা চট্টগ্রাম শহরের একটি বেসরকারি কলেজে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে পুরো বিষয়টি নিয়ে সরকারের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন। পুরো ঘটনা তদন্ত করার জন্য তৎকালীন চ্যান্সেলর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এক সদস্যবিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেন এবং সেই কমিটি তদন্তপূর্বক এক অদ্ভুত প্রতিবেদন দাখিল করে যার উপসংহারে লেখা ছিল ‘এই উপাচার্যকে রেখে সমস্যার সমাধান হবে না এবং তাঁকে সরিয়েও সমস্যার অবসান হবে না।’ সেই বিচারপতি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। সেই প্রতিবেদনের আলোকে চ্যান্সেলর ধর্মঘট সমর্থক এবং বিরোধী পক্ষ—উভয় পক্ষের শিক্ষকদের তাঁর দপ্তরে ডেকেছিলেন। এই লেখকেরও সেই সভায় উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে চ্যান্সেলর মহোদয় অনেক কথা বলেছিলেন, যার প্রত্যেকটা কথা আমার ডায়রিতে লেখা আছে। তিনি বলেছিলেন, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন কোনো আদালতের রায় নয় এবং তা মানতে সরকার বাধ্যও নয়। 
বেগম জিয়া ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে ১১ জন নির্বাচিত এবং মনোনীত উপাচার্য, উপউপাচার্য ও ট্রেজারারকে ১৮৯৭ সালের সেই আইন দিয়ে তাঁদের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলন। তখন কিন্তু আজকে যাঁরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করছেন, তাঁদের কেউ টুঁ শব্দটি করেননি। এটি অবশ্যই বলতে হবে, যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে তখনই অন্য আর দশটি জায়গার মতো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও প্রায় ক্ষেত্রে অচল অবস্থা সৃষ্টির সুযোগ প্রথমে করে দিয়েছে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু অছাত্র এবং কিছু বর্ণচোরা আওয়ামী লীগ সমর্থক। যারা প্রত্যেকে মনে করেছে বর্তমান উপাচার্য নয়, তাদের কেউ একজন উপাচার্য হওয়া উচিত ছিল। তাদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার জন্য অনেক সময় অত্যন্ত অনৈতিকভাবে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করেছে। 
জাহাঙ্গীরনগর বা বুয়েটে যে কারণে সবার সম্মিলিত প্রয়াসে এত দিন পড়ালেখা বন্ধ ছিল তার দায়ভার তো শিক্ষকদেরই নিতে হবে। প্রথমে বলে নিই, এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে আমার তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। বুয়েটের উপাচার্যকে একটু বেশি চেনার সুযোগ হয়েছে। কারণ, আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য পরিষদের সভাপতি ছিলাম, তখন তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। জাহাঙ্গীরনগরের ড. শরিফ এনামুল কবিরের সঙ্গে একবার একটা সেমিনারে দেখা হয়েছে। শুনেছি তিনি পণ্ডিত ব্যক্তি। বুয়েট এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যাকে নিয়ে দেশের মানুষ গর্ব করে। তেমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করার সব আয়োজন বলতে গেলে শুরু হয়েছে। এটি জাতির জন্য একটি চরম দুর্ভাগ্য। 
পত্রিকায় লেখা হয়, বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কথাটি সত্য, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিজ্ঞাপন দেওয়া এবং নিয়োগ-প্রক্রিয়া শেষ করার মধ্যে প্রায়ই দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। এর মধ্যে অনেক শিক্ষক অবসরে যান, কেউ কেউ শিক্ষা ছুটিতে। পদ খালি হয়। কোনো কোনো সময় নতুন বিভাগও খোলা হয়। আবার কোনো সময় সরকারের আদেশের কারণে সব নিয়োগ-প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগে দীর্ঘ ১১ বছর শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ ছিল। অন্যটিতে সাত বছর। 
তবে একটা কথা না বললেই নয়, কোনো উপাচার্যেরই কখনো কোনো ছাত্রসংগঠনকে তাঁর উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। সব শেষে বলি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হটাও আন্দোলনের সময় কোনো কোনো সাংসদ সেখানে গিয়েছেন। তা ঠিক বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত ছিল না। একজন উপাচার্যের শুধু পাণ্ডিত্য থাকলেই হবে না, তার সঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অপরিহার্য। তা একাডেমিক এবং প্রশাসনিক। টিকে থাকুক আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এগুলো সাধারণ ছাত্রছাত্রীদেরও শেষ ভরসাস্থল। এখান থেকেই তৈরি হবে আগামী দিনের নেতারা, যাঁরা দেশ-সমাজ আর জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। মহামান্য চ্যান্সেলর কী করেন তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম। এ বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার একান্তভাবে তাঁর।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন