শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১২

লাভের গুড় যেন পিঁপড়ায় না খায়


যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক জনমত জরিপকারী প্রতিষ্ঠান গ্যালপ সম্প্রতি এক জরিপ কাজের ফলাফল প্রকাশ করে বলেছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর দেশের ৭৭ ভাগ মানুষের আস্থা আছে। গ্যালপ জরিপ কাজটি চালিয়েছে এশিয়ার ২১টি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের ওপর দেশের মানুষের কেমন আস্থা আছে, তা জানার জন্য। গ্যালপের জরিপে দেখা যায় জনগণের আস্থার দিক থেকে শেখ হাসিনার অবস্থান সপ্তম এবং তিনি ভারত, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীদের ওপরে অবস্থান করছেন। ২১তম স্থান দখল করে আছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি। গ্যালপ ২০১১ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই জরিপ চালায়। ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ জরিপ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন জর্জ গ্যালপ। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের আরও বেশ কটি জরিপকারী ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। বর্তমানে গ্যালপ ১৪০টি দেশে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। তবে এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জরিপ হচ্ছে, নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা যাচাই আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা জরিপ। কখনো যদি দেখা যায় যে প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা পঞ্চাশের নিচে চলে এসেছে, তখন হোয়াইট হাউস নড়েচড়ে বসে। আর নির্বাচনের সময় তারা নিয়মিত জরিপ চালিয়ে বলে দেয়, কোন প্রার্থীর বিজয়ের সম্ভাবনা বেশি। কদাচিৎ তাদের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল হতে দেখা যায়। মনে করা হয়, তাদের পরিচালিত জরিপ অত্যন্ত বিজ্ঞানভিত্তিক, স্বচ্ছ এবং পদ্ধতিগতভাবে ত্রুটিমুক্ত। 
দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার প্রতি এখনো ৭৭ ভাগ জনগণের আস্থা আছে, তা জেনে দল তো বটেই, আওয়ামী লীগ ঘরানার সব মানুষ উৎফুল্ল। কোনো কোনো পত্রিকা তা ব্যানার হেডলাইন করেছে, কোনোটি এক কলাম আবার কোনোটি তার উল্লেখও করার প্রয়োজন মনে করেনি। কেউ কেউ এই জরিপের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন। আর বিরোধী শিবির স্বাভাবিকভাবেই মনে করেছে, এটিও জনগণকে বিভ্রান্ত করার আওয়ামী লীগের আর একটি কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়। কয়েকজন ব্লগার আবার ঠাট্টা করে লিখেছে, গ্যালপ এটা আবার কী? কোথা থেকে এল? কার স্বার্থ রক্ষা করছে? এটা নিশ্চয় সজীব ওয়াজেদ জয়ের কারসাজি। আর যারা দলকানা তারা তো ঢেকুর তুলে বলছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ঠেকায় কে? এদিকে আবার সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী কাপাসিয়ার জনসভায় বলেছেন, এবার ক্ষমতাচ্যুত হলে আওয়ামী লীগ আর ৪২ বছরেও ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলেও বসতে পারবে না। এলডিপি নেতা কর্নেল (অব.) অলির 
সময়সীমা তো সংসদের সামনের বাজেট অধিবেশনের আগেই শেষ। কেউ কেউ এসব বক্তব্যকে সমীকরণ করে মন্তব্য করেছেন যে এখন বোঝা গেল, কেন বিএনপিসহ অন্যরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য এত আদাজল খেয়ে লেগেছে। যেকোনো উপায়েই হোক, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে হবে। এমন চিন্তা অবশ্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নয়। মুখে যে যত কথাই বলুক, আসলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধাচরণের সময় হলে সবাই একজোট। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ ২১ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল ক্ষমতায় ফিরতে। এখনো দেশের ৭৭ ভাগ জনগণের শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা আছে। তার কারণ সম্ভবত এটাই যে এই মানুষগুলো অন্য নেতা-নেত্রীদের শাসন, দুঃশাসন ও অপশাসন দেখেছে এবং হয়তো মনে করছে, ওই সব ব্যক্তির শাসনের চেয়ে বর্তমান শাসন কিছুটা ভালো এবং তার তারা শেখ হাসিনাকেই শেষ ভরসাস্থল বলে মনে করে। এটি মনে হওয়ার একটাই কারণ আর তা হচ্ছে, দেশের মানুষ দেখে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সবকিছু প্রধানমন্ত্রীকেই করতে হচ্ছে এবং তাঁর চারপাশে যাঁরা তাঁকে সর্বক্ষণ ঘিরে রেখেছেন তাঁদের যোগ্যতা, নিষ্ঠা, সততা এবং সরকারের প্রতি আনুগত্য নিয়ে মানুষের যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
যুক্তিসংগত কারণেই অনেকে মনে করেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে বর্তমানে যাঁরা তাঁর চারপাশে তাঁকে ঘিরে রাখেন, তাঁদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছাত্রলীগ সম্পর্কে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর একটা মন্তব্য এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পরপর সারা দেশে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত যেভাবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়িয়েছে এবং শুরু হতেই তারা সরকারকে যেভাবে বেকায়দায় ফেলেছে, তাতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, আওয়ামী লীগ যখন বিপদে থাকে, তখন ছাত্রলীগকে খুঁজে পাওয়া যায় না আর যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকে, তখন তারা সবাই বাঘের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাঁর কথা তখনো যেমন সত্য ছিল, এখনো ঠিক ততখানি সত্য। গ্যালপ যদি ছাত্রলীগের ওপর জনসমর্থনের একটা জরিপ চালাত, তাহলে হয়তো দেখা যেত দেশের ১০০ ভাগ জনগণ বলছে, এ সংগঠনটির ওপর তাদের আস্থা বা সমর্থন নেই। অথচ এটি এমন একটি সংগঠন, যার আছে এক ঈর্ষণীয় ঐতিহ্য, যা জাতিকে উপহার দিয়েছে বেশ কজন বড় মাপের নেতা। অথচ সে সংগঠনের নাম শুনলে এখন মানুষ শুধু চোখের সামনে রামদা আর চাপাতি হাতে কিছু চাঁদাবাজ আর ধান্ধাবাজ দেখে 
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর জনিপ্রয়তা ছিল আকাশচুম্বী। গত ৪০ বছরে যতগুলো সরকার ক্ষমতায় ছিল, সার্বিক বিচারে তার তুলনায় বঙ্গবন্ধুর সরকার ছিল সবচেয়ে দক্ষ এবং কার্যকর। কারণ অন্য কোনো সরকারকে বঙ্গবন্ধু সরকারের মতো এত বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মুখোমুখী হতে হয়নি। উত্তরাধিকার সূত্রে বঙ্গবন্ধু যে রকম একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পেয়েছিলেন, সেই দেশটিকে তিনি সাড়ে তিন বছরের মাথায় যে জায়গায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব হতো কি না সমালোচকদের ভেবে দেখতে বলি। তবে বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় মাপের একজন নেতাও কিন্তু তাঁর চারপাশে থাকা কিছু স্তাবকের পরামর্শ, কর্মকাণ্ড ও ষোলোই ডিসেম্বরের পর জন্ম নেওয়া কিছু স্বঘোষিত মুক্তিযোদ্ধার অপরিণামদর্শী কার্যকলাপের জন্য তাঁর সেই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা কম গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সৌভাগ্য ছিল তাঁর বা আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার মতো সে সময়ে তেমন কোনো ব্যক্তি বা দলের জন্ম হয়নি। সে কারণেই ১৫ আগস্টের কুচক্রীরা তাঁকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করার পন্থাটাই বেছে নিয়েছিল। বর্তমান বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষের অভাব নেই। আর অন্য বাস্তবটাও সত্য, ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ তার শত্রু কে আর মিত্র কে তা চিনতে ভুল করেছে। ভুল মানুষকে নিয়ে পথ চলেছে, অযোগ্য মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছে, শেষ পর্যন্ত সবাইকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। 
দেশের ৭৭ ভাগ মানুষের শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা আছে কথাটা শুনতে খুব ভালো। পরের প্রশ্নটি হচ্ছে, তারপর কী? পারছেন কি শেখ হাসিনা তাঁর এই ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে? বলতে দ্বিধা নেই, এই সহজ প্রশ্নের এ মুহূর্তে সরল উত্তর হচ্ছে না, তিনি তাঁর জনপ্রিয়তার পুরোটাই কাজে লাগাতে পারছেন না। না পারার প্রধান কারণ, তিনি সর্বক্ষেত্রে যোগ্য মানুষকে কাজে লাগাতে পারেননি। বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকেরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাঁদের দাবি-দাওয়া নিয়ে অবস্থান ধর্মঘট করছিলেন। তাঁরা তো কোথাও গাড়ি ভাঙচুর বা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাতে যাননি। তাহলে তাঁদের ওপর কেন হঠাৎ পুলিশের জলকামান ব্যবহার? নিশ্চয় পুলিশকে কেউ হুকুম দিয়েছেন। যে বা যারা এই হুকুম দিয়েছেন, তারা কি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল? প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বুধবার ধর্মঘটি শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাঁদের দাবি-দাওয়া পূরণের ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন। সে কাজটি তো জলকামান ব্যবহার করার আগে করা যেত। 
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার মাঝখানে বিএনপি বা তার মিত্ররা তেমন ফ্যাক্টর নয়। বিএনপি আর জামায়াত ছাড়া বাকি সব দলই বস্তুতপক্ষে হোন্ডা পার্টি। ক্ষমতায় পুনরায় ফেরা না-ফেরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ ঘোষিত দৈনন্দিন জনজীবনের চাহিদা সম্পৃক্ত কিছু প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশে এসব বিষয় সব সময় সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। এগুলোর কোনো কোনোটিতে সরকারের অর্জন আছে সত্য, তবে তা যথেষ্ট নয় বলে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস। সরকারের বাকি দেড় বছর সময়ের মধ্যে এসব প্রতিশ্রুতির অনেকগুলোর বাস্তবায়ন একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। আর কোনো বাস্তবসম্মত কারণে কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে সম্ভব না হলে তা সরকারকে জনগণের সামনে পরিষ্কার ভাষায় বলতে হবে, কেন সম্ভব হলো না। তা না হলে মানুষ তার নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করবে। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে যেমন তার অর্জনগুলো সঠিকভাবে প্রচার করতে পারে না, ঠিক তেমনি সরকারের অর্জনগুলোও প্রচারে ব্যর্থ হয়। সরকারের যে কয়েকটি মন্ত্রণালয় খুবই দুর্বল বলে মনে হয় তার মধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয় অন্যতম। বিএনপির একটি বড় গুণ, তার তিল পরিমাণ অর্জনকে তাল করতে পারঙ্গম। আওয়ামী লীগ ঠিক তার উল্টো, যা বর্তমানে সরকারের কার্যকলাপেও স্পষ্ট। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ শক্তি যেভাবে গণমাধ্যমকে তাদের প্রচারের জন্য ব্যবহার করতে পারে, আওয়ামী লীগ তা কখনো পারেনি। এটি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য আরেক বড় ব্যর্থতা। 
শেখ হাসিনার প্রতি ৭৭ ভাগ মানুষের আস্থা আছে, তার অর্থ এই নয়, সরকারের কার্যকলাপের প্রতি ৭৭ ভাগ মানুষের আস্থা আছে। তেমনটি ভাবলে ভুল হবে। বরং ভাবতে হবে, তাঁর প্রতি এই আস্থাটাকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে সরকারের অবাস্তবায়িত জনসম্পৃৃক্ত এজেন্ডাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পুনরায় ক্ষমতায় ফিরতে হলে এর বিকল্প নেই। বর্তমান সরকারের আমলে অর্জন অনেক। এখন দেখতে হবে, লাভের সব গুড় যেন পিঁপড়ায় না খায়। 
সবশেষে একটা কথা না বললেই নয়। এক ড. ইউনূসের পেছনে সরকারের এত শক্তি ক্ষয় করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তাতে লাভ নেই। এই মুহূর্তে নিজের চরকায় তেল দেওয়া অনেক বেশি প্রয়োজন। 
 আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন