শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

মোজাফ্ফর স্যার, এক প্রবাদপুরুষের প্রতিচ্ছবি


ড. মোজাফ্ফর আহমদ
ড. মোজাফ্ফর আহমদ
১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসে যখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নিলাম, তখন আমার অনেক বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছাড়াও তিনজন মানুষ অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে অভিনন্দন জানান। প্রথমজন আমার অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ ফারুক। স্যার আমাকে ছাত্রজীবন থেকেই অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং তাঁর একাধিক গবেষণাকর্মে আমাকে কাজে লাগিয়েছেন। দ্বিতীয়জন প্রতিবাদী লেখক আহমদ ছফা। তাঁর সঙ্গেও আমার পরিচয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকে। মধ্য ষাটের দশকে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের পেছনে শরিফ মিয়ার ছোট ছাপরাঘরের ক্যানটিনকে ঘিরে নিয়মিত কবি-লেখকদের আড্ডা হতো। আলাপকালে আবিষ্কার হলো, আমরা দুজনই চট্টগ্রামের সন্তান। আহমদ ছফার লেখনী কিছুটা ভিন্ন ধারার হলেও তা ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী এবং তাঁর আচার-ব্যবহারও ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। আমার উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই দুজন ব্যক্তি আমাকে চিঠি লিখে অভিনন্দন জানান এবং সাফল্য কামনা করেন। ছফা ভাইয়ের চিঠির শুরুটা ছিল এ রকম, ‘জীবনে এই প্রথমবার কাউকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখছি।’ আর শেষজন ফোনে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তিনি ড. মোজাফ্ফর আহমদ। তিনজনই এখন প্রয়াত। 
২০০৮ সালের জানুয়ারি মাস থেকে আমি মোজাফ্ফর স্যারের প্রতিবেশী। দেখা হতো নিয়মিত। কখনো মসজিদে আবার কখনো বা পথে। স্যার যদিও আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু বাস্তবে তিনি শিক্ষকের চেয়েও অনেক বেশি ছিলেন। স্যারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল আশির দশকে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত ব্যবস্থাপনা শিক্ষা উন্নয়ন-বিষয়ক একটি প্রকল্পে। তিনি কয়েক বছরের জন্য এই প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। আরও কয়েকজনের সঙ্গে আমিও তাঁর সহযোগী। স্যারের সঙ্গে কাজ করার একটা বড় সুবিধা হচ্ছে, নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে তর্ক করা যেত এবং তিনি আমার যুক্তিতর্ক সহজে গ্রহণ করতেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার তিনি প্রফেসরদের নির্বাচনী বোর্ডে একজন বিশেষজ্ঞ সদস্য হয়ে এসেছিলেন। আমিও সেই বোর্ডের একজন সদস্য। তিনজনকে প্রফেসর পদে পদায়নের জন্য নির্বাচিত করা হলো। গোল বাধল তাঁদের ক্রমবিন্যাস নিয়ে। স্যার প্রার্থীদের দীর্ঘদিনের সিনিয়রিটির বিন্যাস একটু পরিবর্তন করতে চাইলেন। অন্যরা চুপ। কারণ কেউই স্যারের মতের সঙ্গে দ্বিমত করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। আর আমার সঙ্গে স্যারের যে রকম ঘনিষ্ঠতা ছিল, অন্যদের তা ছিল না। আমি স্যারের ক্রমবিন্যাস পরিবর্তনের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করলাম এবং আমার মতের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরলাম। স্যার চেষ্টা করলেন আমাকে নিবৃত করতে। আমিও কিছুটা নাছোড়বান্দা। শেষে স্যারের উক্তি ‘মান্নানের সাথে যুক্তিতে পারা যায় না।’ শেষতক আমার যুক্তিমতো সিদ্ধান্ত হলো। স্যারের ওই উক্তি সম্ভবত আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রশংসা। এমন প্রশংসা করার মানুষটি ২২ মে আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য না-ফেরার দুনিয়ায় চলে গেলেন।
অধ্যাপক মোজাফ্ফর স্যার একটি বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন, শেষ করেছেন সমাজের নানা অনাচারের বিরুদ্ধে একজন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে। সব সময় প্রশংসিত হয়েছেন তা নয়, কখনো কখনো সমালোচিতও হয়েছেন। কাজ করতে গেলে সমালোচনা হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ সব মানুষ সমালোচনার ঊর্ধ্বে মহামানব বা অতিমানব হতে পারে না। আর বাঙালির সমস্যা হচ্ছে যাঁর সমালোচনা করা হচ্ছে, তিনি এই কারণে না যতটা অসন্তুষ্ট হন, তার স্তাবকেরা হন তার চেয়েও অনেক বেশি। স্তাবকতন্ত্র এ দেশে একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। আবার অনেকে তা পছন্দও করেন এবং তাতে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনেন। 
২০০১ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলো। তা নিয়ে চারদিকে হইচই পড়ে গেল। স্যার আবার এই সংস্থার (টিআইবি) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রধান। টিআইবি আবার নিজ দেশের রিপোর্ট প্রস্তুত করে না। তারা বড়জোর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। ওইবার বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এই দুর্নীতিসূচকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি করতে ১৪টি উপাত্তের প্রয়োজন হয় এবং সে বছর বাংলাদেশের রিপোর্টটি আটটি উপাত্ত দিয়ে তৈরি হয়েছে। মূল রিপোর্টে তা উল্লেখও আছে। সরকারের লোকজন সরকারের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো আন্তর্জাতিক সংবাদ বা রিপোর্ট প্রকাশিত হলে প্রথমে যে কাজটি করে তা হচ্ছে সরাসরি অস্বীকার করা। সেবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। আর বাস্তবতা হচ্ছে সবগুলো উপাত্ত থাকলে কি বাংলাদেশের দুর্নীতিসূচকের কোনো পরিবর্তন হতো? সম্ভবত না। যার প্রমাণ পরবর্তী চার বছরের সূচক। স্যারকে একবার আমি ওই প্রথম সূচকের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি সরাসরি আমাকে বলেছিলেন, ওই রিপোর্ট প্রস্তুতে তাঁদের কোনো হাত ছিল না, তাঁরা শুধু তা প্রকাশ করেছেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে (ডেপুটি চেয়্যারম্যান)। ওই কমিশনে অর্থনীতিবিদ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ড. মোজাফ্ফর আহমদ, ড. মুহম্মদ ইউনূসের মতো ব্যক্তিরা। সদস্য ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক আনিসুর রহমানের মতো অর্থনীতিবিদেরা। বঙ্গবন্ধুর অনেক অসাধারণ গুণের মধ্যে একটি বড় গুণ ছিল তিনি কাজের মানুষকে মূল্যায়ন করতে পারতেন আর ঠিকই বুঝতে পারতেন কাকে দিয়ে কী কাজ হবে। কখনো তিনি ছাগল দিয়ে হালচাষ করতে চাইতেন না, বর্তমানে যেমনটি অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়। বঙ্গবন্ধুর এই গুণটি তাঁর পরম শত্রুও স্বীকার করবেন। সঠিক মানুষকে সঠিক জায়গায় কাজে লাগানোর ফলে তিনি সাড়ে তিন বছরে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আবার নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করাতে পেরেছিলেন। তিনিই ছিলেন এই রকম গুণে গুণান্বিত বাংলাদেশের শেষ রাষ্ট্রনায়ক। সেই মোজাফ্ফর স্যারকে দেখি সামরিক শাসক জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হতে, যেমনটি হয়েছিলেন বাংলার বিবেক হিসেবেখ্যাত অধ্যাপক আবুল ফজল অথবা জিয়ার সঙ্গে খাল কাটতে গিয়েছিলেন এ দেশের অনেক বামপন্থী নেতা। তবে আবুল ফজল বা মোজাফ্ফর স্যার জিয়ার সঙ্গে বেশিদিন কাজ করতে পারেননি। সামরিক শাসকদের সঙ্গে ভদ্র এবং স্বাধীনচেতা মানুষদের কাজ করতে পদে পদে অসুবিধা হয়। সম্ভবত প্রথম দিকে তাঁরা গিয়েছিলেন বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাঁদের হতাশার কারণে। মোজাফ্ফর স্যার এক-এগারোপরবর্তী মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের প্রতিও তাঁরা সমর্থন জানিয়েছিলেন। তিনি তা প্রকাশ্যেই করেছিলেন, অন্য অনেকের মতো গোপনে নয়। এটি স্যারের একটা বড়গুণ। তাঁর কাছে একবার জানতে চাইলাম এই বিষয়ে তাঁর মন্তব্য। তিনি অকপটে জানালেন, তিনি মনে করেছিলেন এক-এগারোর পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন হবে। সেটি তাঁর ভুল ধারণা ছিল।
স্যার যুক্ত ছিলেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন, সুজন বা বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের সঙ্গে। তাঁর অনেক আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত দ্বিমত থাকলেও আমি সব সময় বিশ্বাস করেছি, তিনি যা করছেন তা সরল বিশ্বাসেই করছেন, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে নয়; যা অনেকে করতে অভ্যস্ত। কখনো কখনো মনে হয়েছে তাঁকে কেউ কেউ ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। একবার আমার কন্যাকে নিয়ে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। তিনি এ ব্যাপারে আমাকে দু-একটি কথা বলেছিলেন, যা বোধগম্য কারণেই এখানে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম। মোজাফ্ফর স্যার খুবই ধর্মপরায়ণ মানুষ ছিলেন, কিন্তু কখনো ধর্মান্ধ ছিলেন না। তিনি ও আমি একই মসজিদে নামাজ পড়তে যেতাম। রমজানের তারাবির নামাজের সময় লোডশেডিংয়ের কারণে মসজিদের ভেতর অসম্ভব গরম। স্যার চেয়ারে বসে নামাজ পড়তেন। দেখি তিনি কোনো সংকোচ না করে গায়ের জামাটা খুলে নামাজ শেষ করলেন। তাঁকে ওই মসজিদে আর কখনো দেখা যাবে না। আর কখনো সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা শেষে কোনো টিভি চ্যানেলে তাঁর মন্তব্য প্রকাশ করবেন না। কখনো আমার সুযোগ হবে না তাঁর ড্রয়িংরুমের ষাটের দশকের সোফায় বসে নানা বিষয়ে কথা বলার। তিনি বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য আর কখনো সেই নদীর দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে নৌকা ভাসাবেন না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁকে আর কখনো সোচ্চার হতে দেখা যাবে না। আমি হয়তো তাঁর পরিবারের কাছে প্রতিবেশী থাকব আরও কিছু দিন। কিন্তু তাঁর মতো করে কেউ বলবেন না ‘মান্নানের সাথে যুক্তিতে পারা যায় না।’ মোজাফ্ফর স্যারের গুণ ছিল অনেক। জীবনের সব কাজ বা সিদ্ধান্তে যে তিনি ত্রুটিমুক্ত ছিলেন তা-ও নয়। কারণ তিনি একজন মানুষ ছিলেন, কোনো মহামানব বা অতিমানব নন। তাঁর কর্ম তাঁকে আমাদের মাঝে চিরদিন স্মরণীয় করে রাখবে। স্যারের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বিভাজিত শক্তিকে শাসন করা খুব সহজ

ইংরেজরা ভারত উপমহাদেশেকে ২শ’ বছর শাসন ও শোষণ করতে একটা অস্ত্র খুব কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছে আর সেটা হচ্ছে বিভাজনের রাজনীতি। ভারতবর্ষ অসংখ্য ভাষা, কৃষ্টি আর ধর্মের দেশ। জাত পাতের বিভাজনও অনেক ক্ষেত্রে বেশ প্রকট ছিল। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে একটি বিভাজন তৈরি করে তাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সফল হননি। ইংরেজরা সফল হয়েছিলেন। তাদের ২শ’ বছরের শাসনের নীতি ছিল ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ (উরারফব ধহফ জঁষব)। এক সময় কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগ এক সাথে ভারত স্বাধীন করার আন্দোলনে নিয়োজিত ছিল। অনেকটা চালাক ইংরেজদের প্ররোচনায় মুসলীম লীগ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত দ্বিখণ্ডিত করার কর্মসূচী হাতে নিল। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্ব আর ভারত ভাগ সবই ছিল ইংরেজদের কূটবুদ্ধির ফলশ্রুতি। বর্তমানে উপমহাদেশের সব পারস্পরিক সমস্যার মূল জন্মদাতা ওই ইংরেজ শাসকরাই। ব্রিটেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্টভাষী রবিন কুক (১৯৯৭-২০০১) অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় এই সত্যটি তার দায়িত্ব পালনকালেই প্রকাশ করেছিলেন। পাকিস্তানের পাশতুন নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান (১৯১৭-২০০৬) ১৯৮৬ সালে Facts are Facts নামে ভারত ভাগের ওপর এক অসাধারণ গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশ করেন। যাতে তিনি ভারত ভাগের অনেক অকথিত কাহিনী বর্ণনা করেছেন। সেই গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে জিন্নাহ আর মুসলীম লীগ ইংরেজদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। ইংরেজরা তাদের ‘ভাগ করো আর শাসন করো’ নীতিটাকে কৌশলে একটু পরিবর্তন করে তাতে যোগ করে ‘তোমরা বিভাজিত হও আমরা শাসন করি’ (You divide and we rule)। বিভাজনের দায়িত্বটা তারা আমাদের পূর্বপুরুষদের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারা ইংরেজদের হতাশ করেননি। ইংরেজরা উপমহাদেশ ছেড়েছে ১৯৪৭ সালে। সেই অবধি তাদের রেখে যাওয়া মতবাদ এদেশের রাজনীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। দুভার্গ্যজনক হলেও সত্য বাংলাদেশে এই মতবাদকে খুবই যতেœর সাথে লালন করে এদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল যার নেতৃত্বে বাংলাদেশে স্বাধীন হয়েছে সেই আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনসহ আওয়মী লীগপন্থী অনেক পেশাজীবী সংগঠন। কোন্দল, আন্তঃদলীয় কলহ, পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়িতে এই দলের কিছু অর্বাচীন নেতা-নেত্রীর জুড়ি নেই। তাদের এই বিভাজিত হওয়ার দর্শনের প্রথম শিকার হয় তারা নিজে এবং সর্বোপরি ক্ষতিগ্রস্ত প্রগতিশীল শক্তি। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার পারদর্শিতা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মতো এত সুচারুভাবে অন্য কোন দল বা গোষ্ঠী দেখাতে পারবে না। অথচ ঠিক উল্টোটা ঘটে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ দলগুলোর মধ্যে। আদর্শভিত্তিক দল বলে যা বুঝায় তা বিএনপি কখনও ছিল না। এটি কিছু দলছুট, অতিবাম অতি ডান সুবিধাবাদীদের একটা ক্লাব হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। যখন তাদের সামনে যে কোন মূল্যে আওয়ামী লীগ ঠেকানোর একটা বিকল্প আসে তখন তারা সব ভেদাভেদ ভুলে একজোট হতে কোন ধরনের সময়ক্ষেপণ করে না এবং দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা তাদের লক্ষ্য পূরণে সফল হয়। দু’একটা উদহারণ দেওয়া যেতে পারে। 
১৭ জুন ২০১০ সালে চট্টগ্রামে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নাগরিক কমিটির ব্যানারে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। এর আগে তিন তিনবার নির্বাচিত হয়েছেন। তাকে মনে করা হতো একজন জননেতার প্রতিকৃতি। কিন্তু শেষের দিকে তার কিছু অপরিণামদর্শী কর্মকা-ের কারণে তিনি নিজেই তার পরাজয় নিশ্চিত করে এনেছিলেন। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের এই নির্বাচনে দেওয়ার মতো কোন প্রার্থীই ছিল না। তারা বগলদাবা করলেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর সৃষ্ট মুজিব কোট পরা একজন ওয়ার্ড কমিশনার। তাদের মূল শক্তি কিন্তু চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের চরম বিভক্তি। সেই বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে সহজে তারা এই মুজিব কোট পরা ওয়ার্ড কমিশনারকেই মেয়র পদে জিতিয়ে আনল । বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যে বেহাল দশা তাতে আগামীতে ভাল কিছু হওয়ার সম্ভাবনা এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হয়েছে অন্যান্য স্থানের স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও। অথচ দলের অন্তর্কোন্দলের অর্ধেকও যদি কমত তা হলে অনেক আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল । 
দলীয় কোন্দলের কারণে শুধু যে স্থানীয় সরকার বা কোন কোন ক্ষেত্রে উপনির্বাচনে আওয়মী লীগের প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে তাই নয়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ বা প্রগতিশীল ধারার পেশাজীবীদের অনেক সংগঠনের নির্বাচনেও তাদের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে স্রেফ কোন্দল, অনৈক্য আর কাদা ছোড়াছুড়ির কারণে। দেশের বিভিন্ন আইনজীবী সমিতি, সুপ্রীমকোর্ট বার নির্বাচনসহ অনেক পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচন এখানে উল্লেখ্য। তবে সবচাইতে লক্ষণীয় পরাজয়গুলো ঘটেছে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধিবদ্ধ পর্ষদগুলোতে এবং এই পরাজয়ের পেছনে মূল কারণ ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের মধ্যে চরম অনৈক্য এবং ক্ষুদ্র স্বার্থে অন্তর্দলীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়া। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পর্ষদে নির্বাচনে পরাজয়ের পর প্রগতিশীল শিক্ষক নেতারা সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, তাদের হারের মূল কারণ নিজেদের মধ্যে চরম অনৈক্য। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধিবদ্ধ পর্ষদের নির্বাচন। প্রায় সবই আওয়ামীপন্থী নীল দল শোচনীয়ভাবে হেরেছে। হারার কারণ একই, অভ্যন্তরীণ কোন্দল। এর ফলে আগামী দিনগুলোতে উপাচার্য তার কর্মকা- চালাতে মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখীন হবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই পরাজয়ের পেছনে যাদের অবদান তারা হয়ত ঢেঁকুর তুলবেন এই বলে যে, যাক প্রশাসনকে একটা শিক্ষা দেওয়া গেল। কিন্তু পুরো বিষয়টা যে একটি আত্মঘাতী হয়েছে তা কী তারা ভেবে দেখেছেন? দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, তারা মূল দল হতে বের হয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে একটা আলাদা দল করবেন। এই কাজটি তারা ইতোপূর্বেও করেছেন এবং তাতে সব সময় লাভবান হয়েছে প্রতিপক্ষ । এই বিশ্ববিদ্যালয় আবার দীর্ঘদিন ধরে এদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের একটা অভয়াশ্রম। এই বিভাজন সৃষ্টিকারীদের আত্মঘাতী কার্যকলাপের কারণে অতীতে সব সময় অভয়াশ্রম আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। দেশে যখন বহু প্রত্যাশিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ চলছে প্রগতিশীলদের ঘোষণা দিয়ে এমন বিভাজন কাদের স্বার্থ রক্ষা করবে? 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শরিফ এনামুল কবিরকে চলে যেতে হলো । এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি আবার বিচিত্র। উপাচার্যপন্থী আর উপাচার্যবিরোধী। সকলে নাকি আবার বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। একপক্ষ চায় উপাচার্য থাকুক, অন্যপক্ষ তার বিদায়ের জন্য সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে তার দফতরের সামনে বসে পড়লেন। শেষতক উপাচার্যকে যেতে হলো। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সীমা নেই। তবে সবচাইতে মারাত্মক অভিযোগ তিনি তার পদ ধরে রাখার জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করেছেন। এটি যদি তিনি করে থাকেন তবে কাজটিকে কখনও নৈতিকভাবে সমর্থন করা যায় না। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা এবং একজন অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ড. আনোয়ার হোসেনকে সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করেছেন। তার মতো একজন ব্যক্তিকেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলে খোলা মনে গ্রহণ করেছেন তা নয়। আমি আমার অন্য আর একটা লেখায় বলেছিলাম, আন্দোলনকারী শিক্ষকদের মাঝ হতে একজনকে উপাচার্য নিয়োগ করলে সব চাইতে ভাল হয়। চ্যান্সেলর যেটি ভাল মনে করেছেন তাই তিনি করেছেন। তবে এতে সমস্যার পুরো সমাধান হবে তা বিশ্বাস করা কঠিন। এই মুহূর্তে আমরা ড. আনোয়ার হোসেনের সাফল্য কামনা করতে পারি। 
বিভাজন যে শুধু পেশাজীবীদের মধ্যে শুধু সীমাবদ্ধ তা নয়। সরকারী দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ তো এখন একটি দানব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই ঐতিহ্যবাহী দলটি এখন দল, উপদল, কোন্দলে বিভক্ত। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তা পাঁচ ছয়ভাগে বিভক্ত। তাদের কোন প্রতিপক্ষ না থাকাতে তার নিজেরা নিজেদের মধ্য হতে প্রতিপক্ষ বানায় এবং একে অপরের মাথা ফাটায়। এতে খুশি হয়ে যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে ঘাপটি মেরে বসে আছে তারা বলে ‘বাহ বেশ বেশ’। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি করছেন। এটি একটি ন্যায্য দাবি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গণতন্ত্র চর্চা না হলে দেশের রাজনীতিতেও কিভাবে গণতন্ত্র চর্চা হবে? তবে বাস্তবটা হচ্ছে এই মুহূর্তে যদি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটিতেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া হয় এবং তা যদি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায় তা হলে ছাত্রলীগের পরাজয় অবধারিত। তার একমাত্র কারণ ওই আন্তর্কলহ এবং কোন্দল আর তার ওপর যোগ হয়েছে তাদের ভয়াবহ ইমেজ সঙ্কট। 
সব ঠিক থাকলে আর বছর দেড়েক পর সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার এসব বিভাজিত শক্তি নিয়ে কিভাবে সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে মোকাবেলা করবে? বিভাজিত শক্তি তো কখনও শক্তভাবে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারে না। এই মূল্যবান কথা ক’টি বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, সেই ১৮৫৮ সালে যখন তার দেশ ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে জ্বলছিল । 

লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক 
২৫ মে ২০১২

শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

ড. আনসিুজ্জামান সময়রে সাহসী সন্তান




আবদুল মান্নান
এক সময় বলা হতো, যার নাই কোন গতি সে করে ওকালত।ি তখন মধোবী ছাত্ররা এই পশোয় আসত না বলে মনে করা হতো। আর যারা ওকালতি পশো বছেে নতি তাদরে অনকেরেই যশখ্যাতি দশেজুড়ে ছড়য়িে পড়ত। ব্যারস্টিাররে সংখ্যা ছলি হাতগেোনা দু’চারজন এবং তাঁরা হতনে সমাজরে সবচাইতে সম্মানতি ব্যক্ত।ি আমার শহর চট্টগ্রামে চল্লশি আর পঞ্চাশরে দশকে যে ক’জন ভাল উকলি বা ব্যারস্টিার ছলিনে তাঁদরে অনকেরে নাম এখনও এই শহররে মানুষ স্মরণ করে এবং সম্মানরে চোখে দখে।ে ব্যারস্টিার আজমি, ব্যারস্টিার সাইফুদ্দনি সদ্দিকিী, ব্যারস্টিার সানাউল্লাহ (জাতীয় র্পাটরি আনসিুল ইসলাম মাহমুদরে পতিা), ব্যারস্টিার কৃষ্ণ নন্দ,ি ব্যারস্টিার সলমিউল হক মল্কিী এখনও এই শহররে মানুষরে কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। যখন এঁরা ব্যারস্টিার হয়ছেলিনে তখন তাঁদরে পড়ালখোর জন্য সুদূর লন্ডনে যতেে হয়ছেলি। র্বতমানে অনকে মধোবী ছলেমেয়েে এই পশোয় শুধু আসছনেই না তাঁরা যশ ও খ্যাতি নয়িে পশোয় নয়িোজতিও । এঁদরে অনকেইে নম্নি আদালত হতে দশেরে র্শীষ আদালতরে বচিার কাজওে নয়িোজতি। কউে কউে রাজনীততিে এসে সফল হয়ছেনে।
এখন ব্যারস্টিার হওয়ার জন্য বদিশে পাড়ি দতিে হয় না। দশেে বসইে পড়ালখো করে বদিশেে গয়িে পরীক্ষা দয়িে ব্যারস্টিার হওয়া যায়। আদালতপাড়ায় গলেে এখন অনকে ব্যারস্টিাররে দখো মলিব।ে 
এই ব্যারস্টিার আইনজীবীদরে একজনরে সাম্প্রতকি আচরণে দশেরে মানুষ তো বটইে খোদ আদালতরে বচিারপতওি ক্ষুব্ধ হয়ছেনে। ব্যারস্টিার ফখরুল ইসলাম মানবতাবরিোধী ও যুদ্ধাপরাধরে দায়ে অভযিুক্ত সালাহউদ্দনি কাদরে চৌধুরীর একজন কৗেঁসুল।ি র্বতমান সরকাররে যা কছিু র্অজন তার অন্যতম হচ্ছে একাত্তররে মানবতাবরিোধী ও যুদ্ধাপরাধরে দায়ে যারা অভযিুক্ত বশিষে ট্রাইব্যুনালরে মাধ্যমে এ সরকার তাদরে বচিাররে ব্যবস্থা করছে।ে ২০০৮ সালরে নর্বিাচনরে আগে আওয়ামী লীগ জনগণরে কাছে প্রতশ্রিুতি দয়িছেলি: তারা ক্ষমতায় গলেে এই অপরাধীদরে বচিাররে মুখোমুখি করব।ে কছিুটা দরেতিে হলওে তারা তাদরে প্রতশ্রিুতি রখেছেে এবং র্বতমানে দু’টি ট্রাইব্যুনালে এই অপরাধরে সঙ্গে সম্পৃক্ত অপরাধীদরে বচিাররে ব্যবস্থা করা হয়ছে।ে যাদরে বচিাররে মুখোমুখি করা হয়ছেে তাদরে অপরাধ সর্ম্পকে দশেরে সকল মানুষ ওয়াকবেহাল। তারপরও সভ্যসমাজরে রীতনিীতরি প্রতি শ্রদ্ধা জানয়িে সরকার তাদরে আত্মপক্ষ সর্মথন করার সুযোগ দয়িছেে এবং এমনকি পরর্বতীকালে রায়রে বরিুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করার সুযোগ দয়িছে।ে বচিার হচ্ছে উন্মুক্ত আদালতে এবং মডিয়িার সামন;ে কোন গোপন বচিারালয়ে নয়। বদিশেীরা এসওে এই বচিার কাজ আদালতরে অনুমতি সাপক্ষেে র্পযবক্ষেণ করতে পারনে। বশ্বিরে কোন যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবরিোধী অপরাধীর বচিার এমন উদারভাবে অতীতে কখনও হয়ন।ি এই বচিার ব্যবস্থাকে বাঞ্চাল করার জন্য দশেে এবং দশেরে বাইরওে নানামুখী ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং এর জন্য জামায়াত কোটি কোটি টাকার তহবলি সংগ্রহ করছেে বলে ইতোমধ্যে বভিন্নি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশতি হয়ছে।ে 
সালাহউদ্দনি কাদরে চৌধুরী, যনিি সাকা চৌধুরী নামে র্সবাধকি পরচিতি; র্বতমানে তার বরিুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ চলছ।ে সাক্ষ্য দতিে এসছেলিনে এই দশেরে র্সবজন শ্রদ্ধয়ে বশিষ্টি বুদ্ধজিীবী ও শক্ষিক ঢাকা বশ্বিবদ্যিালয়রে প্রফসের এমরিটোস ড. আনসিুজ্জামান। প্রথমে স্যারকে প্রাণঢালা অভনিন্দন জানাই প্রায় পঁচাত্তর বছর বয়সওে সত্যরে প্রতি তাঁর অঙ্গীকার এবং দায়বদ্ধতা এতটুকু কমনে।ি স্যারকে যাঁরা চনেনে তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করবনে ড. আনসিুজ্জামানরে জন্য এটাই ছলি স্বাভাবকি। এর আগে শহীদ জননী জাহানারা ইমামরে নতেৃত্বে একাত্তররে যুদ্ধাপরাধীদরে বচিাররে জন্য যে গণআদালত বসছেলি সে আদালতরে সঙ্গে স্যার সম্পৃক্ত ছলিনে এবং পরে বগেম জয়িার প্রথম সরকাররে সময় এই আদালতরে সঙ্গে সম্পৃক্ত চব্বশি জনরে বরিুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহতিামূলক মামলা দয়ো হয়; যার মধ্যে ড. আনসিুজ্জামানও ছলিনে। ড. আনসিুজ্জামান তাঁর ছাত্রছাত্রী এবং জুনয়ির সহর্কমীদরে কাছে আনসি স্যার হসিবেইে পরচিতি এবং সম্মানতি। তনিি র্বতমান প্রধানমন্ত্রীর শক্ষিক এবং তাঁর পা-ত্যিরে খ্যাতি দশেরে সীমানা ছাড়য়িছেে কয়কে দশক আগইে। আমার সুযোগ হয়ছেে স্যাররে সহর্কমী এবং স্নহেধন্য হওয়ার। র্দীঘ দু’দশক ধরে তাঁর সঙ্গে শক্ষিকতা করছেি কন্তিু কখনও দখেনিি তাঁকে কউে অশ্রদ্ধা করে কথা বলত।ে এমনকি যাঁরা তাঁর মতার্দশরে বরিুদ্ধবাদী তাঁরাও তাঁকে যথষ্টে সম্মান করনে। শুধু একবার একজন সহর্কমীকে দখেছেি স্যার সর্ম্পকে একটা বরিূপ মন্তব্য করত।ে স্যার ও অন্যান্যরে বরিুদ্ধে যখন সরকার বাদি হয়ে রাষ্ট্রদ্রোহতিার মামলা করে তখন স্যার পরীক্ষার একটা কাজে চট্টগ্রাম বশ্বিবদ্যিালয়ে এসছেলিনে। সে সময় একজন জামায়াতপন্থী শক্ষিক লাউঞ্জে বসে মন্তব্য করছেলিনে ‘আজ ক্যাম্পাসে একজন রাষ্ট্রদ্রোহীর আগমন ঘটছে।ে’ এই মন্তব্য শুনে পাশে বসা তাঁর আর এক সহর্কমী তীব্র ভাষায় প্রতবিাদ করছেলিনে। 
গত মঙ্গলবার বশিষে ট্রাইব্যুনালে সাকার পক্ষরে আইনজীবী ব্যারস্টিার ফখরুল ইসলাম যে ভাষায় কথা বলছেনে বলে সংবাদ পত্রে প্রকাশতি, তা শুধু শষ্টিাচারবহর্ভিূতই নয়; এই পশোর প্রতি চরম অবমাননা। আইন পশো ভদ্র মানুষদরে পশো হসিবেইে সকলে জান।ে ইদানীং এই পশোয় নয়িোজতি কছিু আইনজীবী যখন আদালত প্রাঙ্গণে যে ধরনরে আচরণ করনে তা দশেে সাধারণ জনগণকে বশে ক্ষুব্ধ এবং আশাহত করে তখন আদালতরে যে একটি অর্ন্তনহিতি পবত্রিতা আছে তা ভুলুণ্ঠতি হয়। সম্ভবত ১৯৬৭ সালে বাবার সঙ্গে প্রথমবার আমার সুযোগ হয়ছেলি ঢাকা হাইর্কোটে যাওয়ার একটি পারবিারকি মামলার শুনানরি সময়। তখন আমাদরে পারবিারকি আইনজীবী ছলিনে এ্যাডভোকটে মোফাখ্খারুল ইসলাম। তনিি হাইর্কোট আইনজীবী সমতিরি সভাপতওি নর্বিাচতি হয়ছেলিনে। সাবকে তত্ত্বাবধায়ক সরকাররে উপদষ্টো এএসএম হাসান আরফি তখন তাঁর জুনয়ির হসিবেে কাজ করছলিনে। মোফাখ্খার সাহবেরে সঙ্গে আদালতরে উদ্দশ্যেে রওনা হওয়ার আগে তনিি আমাকে বলছেলিনে আমার জামার গুটানো আস্তনিটা নামাত।ে আস্তনি গুটয়িে হাইর্কোটরে বারান্দায় হাঁটাও নাকি আদালত অবমাননার শামলি। এখন তো কোন কোন আইনজীবী আদালত প্রাঙ্গণে নয়িমতি সংঘাত-সংর্ঘষে লপ্তি হন। পারস্পরকি শ্রদ্ধাবোধ এখন এদশেে র্সবনম্নি র্পযায়ে এসে ঠকেছে।ে জাতি হসিবেে এটি নঃিসন্দহেে আমাদরে জন্য চরম লজ্জাজনক। 
একাত্তররে শুরু থকেইে চট্টগ্রাম বশ্বিবদ্যিালয়ে র্কমরত অবস্থায় মুক্তযিুদ্ধরে প্রস্তুতর্পিবে ড. আনসিুজ্জামানসহ চট্টগ্রাম বশ্বিবদ্যিালয়রে অধকিাংশ শক্ষিক, ছাত্র ও র্কমচারী বাংলাদশেরে স্বাধীনতা আন্দোলনরে সঙ্গে জড়তি হয়ে পড়নে। চট্টগ্রাম বশ্বিবদ্যিালয়রে অবস্থান হলো অনকেটা চট্টগ্রাম সনোনবিাস লাগোয়া। এপ্রলিরে প্রথম সপ্তাহে পাকস্তিানী সনোবাহনিী চট্টগ্রাম শহররে অধকিাংশ এলাকা দখল করে উত্তর ও র্পূবদকিে অগ্রসর হতে থাক।ে এ সময় পাকস্তিান সনোবাহনিী র্কতৃক চট্টগ্রাম বশ্বিবদ্যিালয়ে অভযিান অনকেটা নশ্চিতি হয়ে পড়।ে তা বুঝতে পরেে বশ্বিবদ্যিালয় ক্যাম্পাসে বসবাসরত সবাই ১ এপ্রলিরে মধ্যে ক্যাম্পাস ত্যাগ করনে। দক্ষণি দকিে যহেতেু সনোনবিাস সহেতেু সদেকিে কারও পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছলি না। সবাই ছুটলনে উত্তর ও র্পূব দকি।ে প্রায় কুড়টিরি মতো পরবিারকে আশ্রয় দলিনে কু-শ্বেরী ঔষধালয়রে র্কণধার দানবীর নূতন চন্দ্র সংিহ। সইে সব পরবিাররে অন্যতম ছলিনে ড. আনসিুজ্জামানরে পরবিার। সখোনে ক’দনি অবস্থানরে পর ৫ থকেে ৭ তারখিরে মধ্যে সবাই সীমান্তরে উদ্দশ্যেে তাদরে নূতন চন্দ্রসংিহরে আশ্রয়স্থল ত্যাগ করার পর ১৩ এপ্রলি পাকস্তিান সনোবাহনিী সাঁজোয়া যানসহ সখোনে প্রবশে কর।ে সঙ্গে ছলি মুসলমি লীগ নতো ফজলুল কাদরে চৌধুরীর বড় ছলেে সাকা চৌধুরী। বশ্বিবদ্যিালয় শক্ষিকদরে নূতন চন্দ্র সংিহ আশ্রয় দয়িছেনে এই অজুহাতে সাকা ও পাকস্তিান সনোবাহনিী তাঁকে মন্দরিরে সামনে র্প্রাথনারত অবস্থায় গুলি করে মার।ে সে হত্যাকা-রে মূল নায়ক ছলি সাকা চৌধুরী, যনিি এখন বগেম জয়িার একজন উপদষ্টো ও কাছরে মানুষ। ড. আনসিুজ্জামান এসব বষিয়ে সাক্ষী দতিে বশিষে ট্রাইব্যুনালরে সামনে হাজরি হয়ছেলিনে। 
একাত্তরে সাকা চৌধুরীর নৃশংস ভূমকিা সর্ম্পকে চট্টগ্রামরে সে সময়কার সব মানুষ অবহতি। শহরস্থ তাদরে গুডস্ হলিরে বাসভবনে যে ভয়াবহ নর্যিাতন কন্দ্রে সক্রয়ি ছলি তার কথা মনে হলে এখনও অনকেে শউিরে ওঠনে। গুডস্ হলিরে নর্যিাতন কন্দ্রেে নর্যিাততি আমার পরচিতি এখনও তনিজন জীবন্ত সাক্ষী আছ।ে প্রথমজন চট্টলতত্ত্ববদি আবদুল হক চৌধুরীর ছলেে শহীদুল আমনি চীেধুরী, দ্বতিীয়জন সলিটে বজ্ঞিান ও প্রযুক্তি বশ্বিবদ্যিালয়রে র্বতমান উপার্চায ড. সালহেউদ্দনি আহমদে আর শষেজন বশিষ্টি সাংবাদকি র্বতমানে ফন্যিান্সয়িাল এক্সপ্রসেে র্কমরত নজিামউদ্দনি। এমন সাক্ষী আরও আছনে কন্তিু সবার নাম এ মুর্হূতে মনে পড়ছে না । 
ড, আনসিুজ্জামান সাকা চৌয়রে একাত্তররে নৃশংসতার বরিুদ্ধে সাক্ষ্য দতিে গয়িছেলিনে। তাঁর বয়সী কউে এখন তমেন একটা সাহস করনে না। না করার অনকে বাস্তব কারণ আছ।ে আমাদরে দশেে সাক্ষীর নরিাপত্তা বধিানরে কোন আইন নইে। সাক্ষ্য দয়োর পর সাক্ষীর যে কোন ক্ষতি হবে না তার কোন নশ্চিয়তা কউে দতিে পারে না। দশেরে বরণ্যে লখেক হুমাযূন আহমদে, শক্ষিাবদি জাফর ইকবাল ও জনপ্রয়ি র্কাটুনস্টি আহসান হাবীব ভ্রাতাদরে পতিাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়ছেলি। সে হত্যাকা-রে সঙ্গে জড়তি ছলিনে জামায়াত নতো দলোওয়ার হোসনে সাঈদী। প্রসকিউিশন অনুরোধ করছেলিনে তাদরে ট্রাইব্যুুনালরে সামনে গয়িে সাক্ষী দতি।ে হয়ত তাঁদরে ব্যক্তগিত ও পারবিারকি নরিাপত্তার কথা চন্তিা করে এদরে কউেই ট্রাইব্যুনালরে সামনে যতেে রাজি হনন।ি 
কোন সাক্ষীকে ববিাদীর কৗেঁসুলি জরো করবনে এটাই নয়িম। অনকে সময় জরোর মারপ্যাঁচে সাক্ষীকে ঘায়লে করার রয়োজও আছ।ে অভধিানে অনকে শব্দ আছে তা যমেন সংসদে বলা যায় না ঠকি তমেনি আদালতে উচ্চারণ করাও সমীচীন নয়। এ রকম শব্দ এমন পবত্রি অঙ্গনে ব্যবহার করলে তার পবত্রিতা নষ্ট হয়। আর আদালত তো মানুষরে শষে আশ্রয়স্থল। যে আদালতে সাকা গংয়রে বচিার হচ্ছে তা একটি ট্রাইব্যুনাল। তার র্মযাদাই আলাদা। সইে আদালতে ড. আনসিুজ্জামানকে জরোর নামে সাকার কৗেঁসুলি তাঁকে ‘মথ্যিুক’ বলে অবহতি করছেনে। ঘটনার সখোনইে শষে নয়। তনিি আদালত হতে বরে হয়ে টভিি ক্যামরোর সামনে দাঁড়য়িে সাংবাদকিদরে বশে জোর গলায় বললনে ড. আনসিুজ্জামান একজন ‘মথ্যিুক’। এটি একটি জাতকিে হতবাক করার মতো ঘটনা। সম্ভবত এমন কথা ড. আনসিুজ্জামানকে তাঁর পরমতম শত্রুও কখনও বলনে।ি ব্যারস্টিার সাহবেরে এমন অনভপ্রিতে আচরণরে দু’টি কারণ হতে পার।ে প্রথমটি তনিি হয় ড. আনসিুজ্জামান কে তা জাননে না, আর পররেটি তনিি ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে মথ্যিুক বলে আখ্যায়তি করছেনে। স্রফে তাঁর সাক্ষীকে অপমান করার জন্য যমেনটা সুযোগ পলেে তাঁর মক্কলেও করতে পছিপা হতনে না। যমেন মক্কলে তমেন তাঁর কৗেঁসুল।ি কারণ যাই হোক, ব্যারস্টিার ফখরুল ইসলাম আনসি স্যারকে আদালতে মথ্যিুক বলে নজিরে র্মূখতার প্রকাশ ঘটয়িছেনে বলে দশেরে আপামর জনগণরে (একাত্তররে ঘাতক দালালদরে দোসররা ছাড়া) বশ্বিাস। স্বস্তরি বষিয় হচ্ছ,ে ইতোমধ্যে ট্রাইব্যুনাল বষিয়টি আমলে নয়িছেে এবং আগামী ২৭ মে ব্যারস্টিার সাহবেকে ট্রাইব্যুনালে সশরীরে উপস্থতি হয়ে তাঁর বক্তব্য দতিে বলছেনে। ব্যারস্টিার ডগ্রিীধারীরা যদি আদালতে ভদ্র ভাষায় কথা বলতে না পারনে তাহলে র্বতমান প্রজন্ম কাদরে কাছ হতে ভদ্রতা শখিব?ে শুধু লখোপড়া করলইে মানুষ শক্ষিতি হয় না। শক্ষিতি হতে হলে আরও কছিুর প্রয়োজন হয়; যা আমাদরে অনকেরে মাঝে অনুপস্থতি। লখেক : শক্ষিাবদি ও বশ্লিষেক । মে ১৯, ২০১২

শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১২

লাভের গুড় যেন পিঁপড়ায় না খায়


যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক জনমত জরিপকারী প্রতিষ্ঠান গ্যালপ সম্প্রতি এক জরিপ কাজের ফলাফল প্রকাশ করে বলেছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর দেশের ৭৭ ভাগ মানুষের আস্থা আছে। গ্যালপ জরিপ কাজটি চালিয়েছে এশিয়ার ২১টি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের ওপর দেশের মানুষের কেমন আস্থা আছে, তা জানার জন্য। গ্যালপের জরিপে দেখা যায় জনগণের আস্থার দিক থেকে শেখ হাসিনার অবস্থান সপ্তম এবং তিনি ভারত, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীদের ওপরে অবস্থান করছেন। ২১তম স্থান দখল করে আছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি। গ্যালপ ২০১১ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই জরিপ চালায়। ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ জরিপ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন জর্জ গ্যালপ। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের আরও বেশ কটি জরিপকারী ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। বর্তমানে গ্যালপ ১৪০টি দেশে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। তবে এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জরিপ হচ্ছে, নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা যাচাই আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা জরিপ। কখনো যদি দেখা যায় যে প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা পঞ্চাশের নিচে চলে এসেছে, তখন হোয়াইট হাউস নড়েচড়ে বসে। আর নির্বাচনের সময় তারা নিয়মিত জরিপ চালিয়ে বলে দেয়, কোন প্রার্থীর বিজয়ের সম্ভাবনা বেশি। কদাচিৎ তাদের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল হতে দেখা যায়। মনে করা হয়, তাদের পরিচালিত জরিপ অত্যন্ত বিজ্ঞানভিত্তিক, স্বচ্ছ এবং পদ্ধতিগতভাবে ত্রুটিমুক্ত। 
দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার প্রতি এখনো ৭৭ ভাগ জনগণের আস্থা আছে, তা জেনে দল তো বটেই, আওয়ামী লীগ ঘরানার সব মানুষ উৎফুল্ল। কোনো কোনো পত্রিকা তা ব্যানার হেডলাইন করেছে, কোনোটি এক কলাম আবার কোনোটি তার উল্লেখও করার প্রয়োজন মনে করেনি। কেউ কেউ এই জরিপের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন। আর বিরোধী শিবির স্বাভাবিকভাবেই মনে করেছে, এটিও জনগণকে বিভ্রান্ত করার আওয়ামী লীগের আর একটি কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়। কয়েকজন ব্লগার আবার ঠাট্টা করে লিখেছে, গ্যালপ এটা আবার কী? কোথা থেকে এল? কার স্বার্থ রক্ষা করছে? এটা নিশ্চয় সজীব ওয়াজেদ জয়ের কারসাজি। আর যারা দলকানা তারা তো ঢেকুর তুলে বলছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ঠেকায় কে? এদিকে আবার সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী কাপাসিয়ার জনসভায় বলেছেন, এবার ক্ষমতাচ্যুত হলে আওয়ামী লীগ আর ৪২ বছরেও ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলেও বসতে পারবে না। এলডিপি নেতা কর্নেল (অব.) অলির 
সময়সীমা তো সংসদের সামনের বাজেট অধিবেশনের আগেই শেষ। কেউ কেউ এসব বক্তব্যকে সমীকরণ করে মন্তব্য করেছেন যে এখন বোঝা গেল, কেন বিএনপিসহ অন্যরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য এত আদাজল খেয়ে লেগেছে। যেকোনো উপায়েই হোক, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে হবে। এমন চিন্তা অবশ্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নয়। মুখে যে যত কথাই বলুক, আসলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধাচরণের সময় হলে সবাই একজোট। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ ২১ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল ক্ষমতায় ফিরতে। এখনো দেশের ৭৭ ভাগ জনগণের শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা আছে। তার কারণ সম্ভবত এটাই যে এই মানুষগুলো অন্য নেতা-নেত্রীদের শাসন, দুঃশাসন ও অপশাসন দেখেছে এবং হয়তো মনে করছে, ওই সব ব্যক্তির শাসনের চেয়ে বর্তমান শাসন কিছুটা ভালো এবং তার তারা শেখ হাসিনাকেই শেষ ভরসাস্থল বলে মনে করে। এটি মনে হওয়ার একটাই কারণ আর তা হচ্ছে, দেশের মানুষ দেখে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সবকিছু প্রধানমন্ত্রীকেই করতে হচ্ছে এবং তাঁর চারপাশে যাঁরা তাঁকে সর্বক্ষণ ঘিরে রেখেছেন তাঁদের যোগ্যতা, নিষ্ঠা, সততা এবং সরকারের প্রতি আনুগত্য নিয়ে মানুষের যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
যুক্তিসংগত কারণেই অনেকে মনে করেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে বর্তমানে যাঁরা তাঁর চারপাশে তাঁকে ঘিরে রাখেন, তাঁদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছাত্রলীগ সম্পর্কে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর একটা মন্তব্য এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পরপর সারা দেশে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত যেভাবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়িয়েছে এবং শুরু হতেই তারা সরকারকে যেভাবে বেকায়দায় ফেলেছে, তাতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, আওয়ামী লীগ যখন বিপদে থাকে, তখন ছাত্রলীগকে খুঁজে পাওয়া যায় না আর যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকে, তখন তারা সবাই বাঘের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাঁর কথা তখনো যেমন সত্য ছিল, এখনো ঠিক ততখানি সত্য। গ্যালপ যদি ছাত্রলীগের ওপর জনসমর্থনের একটা জরিপ চালাত, তাহলে হয়তো দেখা যেত দেশের ১০০ ভাগ জনগণ বলছে, এ সংগঠনটির ওপর তাদের আস্থা বা সমর্থন নেই। অথচ এটি এমন একটি সংগঠন, যার আছে এক ঈর্ষণীয় ঐতিহ্য, যা জাতিকে উপহার দিয়েছে বেশ কজন বড় মাপের নেতা। অথচ সে সংগঠনের নাম শুনলে এখন মানুষ শুধু চোখের সামনে রামদা আর চাপাতি হাতে কিছু চাঁদাবাজ আর ধান্ধাবাজ দেখে 
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর জনিপ্রয়তা ছিল আকাশচুম্বী। গত ৪০ বছরে যতগুলো সরকার ক্ষমতায় ছিল, সার্বিক বিচারে তার তুলনায় বঙ্গবন্ধুর সরকার ছিল সবচেয়ে দক্ষ এবং কার্যকর। কারণ অন্য কোনো সরকারকে বঙ্গবন্ধু সরকারের মতো এত বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মুখোমুখী হতে হয়নি। উত্তরাধিকার সূত্রে বঙ্গবন্ধু যে রকম একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পেয়েছিলেন, সেই দেশটিকে তিনি সাড়ে তিন বছরের মাথায় যে জায়গায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব হতো কি না সমালোচকদের ভেবে দেখতে বলি। তবে বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় মাপের একজন নেতাও কিন্তু তাঁর চারপাশে থাকা কিছু স্তাবকের পরামর্শ, কর্মকাণ্ড ও ষোলোই ডিসেম্বরের পর জন্ম নেওয়া কিছু স্বঘোষিত মুক্তিযোদ্ধার অপরিণামদর্শী কার্যকলাপের জন্য তাঁর সেই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা কম গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সৌভাগ্য ছিল তাঁর বা আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার মতো সে সময়ে তেমন কোনো ব্যক্তি বা দলের জন্ম হয়নি। সে কারণেই ১৫ আগস্টের কুচক্রীরা তাঁকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করার পন্থাটাই বেছে নিয়েছিল। বর্তমান বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষের অভাব নেই। আর অন্য বাস্তবটাও সত্য, ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ তার শত্রু কে আর মিত্র কে তা চিনতে ভুল করেছে। ভুল মানুষকে নিয়ে পথ চলেছে, অযোগ্য মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছে, শেষ পর্যন্ত সবাইকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। 
দেশের ৭৭ ভাগ মানুষের শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা আছে কথাটা শুনতে খুব ভালো। পরের প্রশ্নটি হচ্ছে, তারপর কী? পারছেন কি শেখ হাসিনা তাঁর এই ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে? বলতে দ্বিধা নেই, এই সহজ প্রশ্নের এ মুহূর্তে সরল উত্তর হচ্ছে না, তিনি তাঁর জনপ্রিয়তার পুরোটাই কাজে লাগাতে পারছেন না। না পারার প্রধান কারণ, তিনি সর্বক্ষেত্রে যোগ্য মানুষকে কাজে লাগাতে পারেননি। বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকেরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাঁদের দাবি-দাওয়া নিয়ে অবস্থান ধর্মঘট করছিলেন। তাঁরা তো কোথাও গাড়ি ভাঙচুর বা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাতে যাননি। তাহলে তাঁদের ওপর কেন হঠাৎ পুলিশের জলকামান ব্যবহার? নিশ্চয় পুলিশকে কেউ হুকুম দিয়েছেন। যে বা যারা এই হুকুম দিয়েছেন, তারা কি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল? প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বুধবার ধর্মঘটি শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাঁদের দাবি-দাওয়া পূরণের ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন। সে কাজটি তো জলকামান ব্যবহার করার আগে করা যেত। 
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার মাঝখানে বিএনপি বা তার মিত্ররা তেমন ফ্যাক্টর নয়। বিএনপি আর জামায়াত ছাড়া বাকি সব দলই বস্তুতপক্ষে হোন্ডা পার্টি। ক্ষমতায় পুনরায় ফেরা না-ফেরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ ঘোষিত দৈনন্দিন জনজীবনের চাহিদা সম্পৃক্ত কিছু প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশে এসব বিষয় সব সময় সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। এগুলোর কোনো কোনোটিতে সরকারের অর্জন আছে সত্য, তবে তা যথেষ্ট নয় বলে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস। সরকারের বাকি দেড় বছর সময়ের মধ্যে এসব প্রতিশ্রুতির অনেকগুলোর বাস্তবায়ন একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। আর কোনো বাস্তবসম্মত কারণে কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে সম্ভব না হলে তা সরকারকে জনগণের সামনে পরিষ্কার ভাষায় বলতে হবে, কেন সম্ভব হলো না। তা না হলে মানুষ তার নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করবে। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে যেমন তার অর্জনগুলো সঠিকভাবে প্রচার করতে পারে না, ঠিক তেমনি সরকারের অর্জনগুলোও প্রচারে ব্যর্থ হয়। সরকারের যে কয়েকটি মন্ত্রণালয় খুবই দুর্বল বলে মনে হয় তার মধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয় অন্যতম। বিএনপির একটি বড় গুণ, তার তিল পরিমাণ অর্জনকে তাল করতে পারঙ্গম। আওয়ামী লীগ ঠিক তার উল্টো, যা বর্তমানে সরকারের কার্যকলাপেও স্পষ্ট। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ শক্তি যেভাবে গণমাধ্যমকে তাদের প্রচারের জন্য ব্যবহার করতে পারে, আওয়ামী লীগ তা কখনো পারেনি। এটি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য আরেক বড় ব্যর্থতা। 
শেখ হাসিনার প্রতি ৭৭ ভাগ মানুষের আস্থা আছে, তার অর্থ এই নয়, সরকারের কার্যকলাপের প্রতি ৭৭ ভাগ মানুষের আস্থা আছে। তেমনটি ভাবলে ভুল হবে। বরং ভাবতে হবে, তাঁর প্রতি এই আস্থাটাকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে সরকারের অবাস্তবায়িত জনসম্পৃৃক্ত এজেন্ডাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পুনরায় ক্ষমতায় ফিরতে হলে এর বিকল্প নেই। বর্তমান সরকারের আমলে অর্জন অনেক। এখন দেখতে হবে, লাভের সব গুড় যেন পিঁপড়ায় না খায়। 
সবশেষে একটা কথা না বললেই নয়। এক ড. ইউনূসের পেছনে সরকারের এত শক্তি ক্ষয় করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তাতে লাভ নেই। এই মুহূর্তে নিজের চরকায় তেল দেওয়া অনেক বেশি প্রয়োজন। 
 আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

রবিবার, ১৩ মে, ২০১২

খাদের কিনার হতে ফেরার সময় হয়েছে


                                                             আবদুল মান্নান

গুরুত্বপূর্ণ তিন বিদেশী ঘুরে গেলেন বাংলাদেশ। অন্যদেশে কোন বিদেশী অতিথি এলে তা নিয়ে তেমন একটা হৈচৈ হয় না যেমনটা হয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশে এমনিতেই সব কিছুতে অতি সন্ন্যাসী আর রাজনীতি হলে তো কথাই নেই। ঠিক এমন অবস্থায় আবার তার সঙ্গে যোগ হয় বিদেশী সন্ন্যাসী । অনেকে আবার মনে করেন যেহেতু আমরা নিজেদের ভাল-মন্দ নিজেরা ঠিকমতো বুঝতে পারি না সে কারণেই অনেক সময় এই বিদেশী সন্ন্যাসীরা এসে আমাদের নিজস্ব ভাল-মন্দ বুঝতে সাহায্য-সহায়তা করেন। আর এই বিদেশী সন্ন্যাসীরা যদি মার্কিন মুলুুক হতে আসেন তা হলে তার কদর বেড়ে যায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ক’দিন আগে বাংলাদেশে সে দেশের রাষ্ট্রদূত নসিহত করলেন মংলাবন্দর ট্রানজিট বন্দর হিসেবে ব্যবহার করতে দিলে তা বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক। জানা ছিল না, এই সহজ কথাটা বুঝতে বাংলাদেশে বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে। তিন বিদেশী অতিথির মধ্যে প্রথমে এলেন জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী। ঐতিহাসিকভাবে জাপান বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। জাপান বাংলাদেশের সবচাইতে বড় সাহায্যদাতা। এদেশে খুব কম প্রকল্পই আছে যেখানে জাপানের অবদান নেই। তবে তাদের খবরদারি তেমন একটা চোখে পড়ে না। এবার জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ত্যাগের আগে এদেশে বিদেশী বিনিয়োগে কি কি বাধা আছে তা পরিষ্কার ভাষায় বলে গেছেন এবং তাঁর কথায় কেউ দ্বিমত করবে না। এ প্রসঙ্গে অন্যত্র আলোচনা করার আশা রইল।
জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ত্যাগের পর কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে বাংলাদেশে এলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং ভারতের অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, সে দেশের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জী। মনে করা হচ্ছে আগামী জুলাই মাসে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়ে যেতে পারেন। তা যদি হয় তা হলে মন্ত্রী হিসেবে এটি সম্ভবত তাঁর শেষ বাংলাদেশ সফর। তবে কংগ্রেস নেত্রী তাঁকে তাঁর মন্ত্রিসভা থেকে ছাড়তে চান না। কারণ, মনে করা হয় ভারতের রাজনীতিতে কোন সঙ্কট দেখা দিলে তা সমাধান করার শেষ অস্ত্রটি প্রণব মুখার্জীর ঝুলিতে আছে। হিলারি ক্লিনটন ছিলেন চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময়। কাজ করেছেন বেশ ক’টি। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সহায়তার সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর, ‘নিখোঁজ’ হওয়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর কন্যার হাত হতে আবেদনমূলক একটি পত্র গ্রহণ, নির্বাচিত সুশীল সমাজের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা, সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রশ্ন-উত্তর পর্ব, ক্লিনটন পরিবারের ব্যক্তিগত বন্ধু শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস এবং ব্র্যাকের কর্ণধার স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে প্রাতঃরাশ এবং সবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খোলামেলা আড্ডা। বলতে দ্বিধা নেই, তার পরের কর্মসূচীটা ছিল অত্যন্ত অর্থবহ। কারণ এখানে শিক্ষার্থীরা অনেক খোলামেলা পরিবেশে হিলারির সঙ্গে সময় কাটাতে পেরেছে। প্রণব মুখার্জীর বাংলাদেশ সফর অনেকক্ষেত্রে হিলারির সফরের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার প্রধান কারণ, তাঁর দেশ বাংলাদেশের সবচাইতে বড় প্রতিবেশী এবং তাঁদের সঙ্গে আমাদের অনেক অমীমাংসিত বিষয় মীমাংসার অপেক্ষায় আছে। আবার এসব বিষয়ের বেশ কিছু বিষয় বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। এসবের যদি একটি গ্রহণযোগ্য সুরাহা না হয় তা হলে তা বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিপক্ষে যাবে বলে বিশ্বাস। অবশ্য প্রণব মুখার্জী বেগম জিয়াকে বলে এসেছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় কোন্ দল ক্ষমতায় থাকল তা তাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। তারা বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। তবে এটি ঠিক, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ভারতের অর্থনৈতিক লাভটা অনেক বেশি যদিও তার নিরাপত্তা ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়।
যাওয়ার প্রাক্কালে হিলারি এবং প্রণব মুখার্জী দু’জনই একটা কথা বলে গেছেন আর তা হচ্ছেÑতাঁরা আগামীতে বাংলাদেশে সকলের অংশগ্রহণমূলক একটি সাধারণ নির্বাচন দেখতে চান। তাঁদের এই মন্তব্যে তেমন নতুন কিছুই নেই। একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। অংশগ্রহণ না করলে তাকে কেউ বাধ্যও করতে পারে না। সত্তরের নির্বাচনে মওলানা ভাসানীর ন্যাপ ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো’ বলে অংশগ্রহণ করেনি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগও অংশগ্রহণ করেনি। ভাসানীর ন্যাপ আর আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে মওলানা ভাসানী শোষিতের বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখতেন; যেমনটি হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনে। মওলানা কোন লেনিন বা মাও সে তুং ছিলেন না। তিনি একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ছিলেন যেমন সত্য তেমন সত্য তিনি নিয়মিত রাজনৈতিক বিভ্রান্তিতে ভুগতেন। আওয়ামী লীগ কোন বিপ্লবী দল নয় এবং তাদের মধ্যে তেমন কোন বিপ্লবী নেতাও নেই। তারা সব সময় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছে। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে তারা দীর্ঘ একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেছে, শেখ হাসিনা তাঁর দীর্ঘ নির্বাসন জীবন শেষ করে দেশে ফিরে ছত্রভঙ্গ আওয়ামী লীগকে জোড়া লাগিয়েছেন এবং ১৯৯১ সালে অপ্রত্যাশিতভাবে দলকে ক্ষমতায় নিতে ব্যর্থ হলেও ১৯৯৬ সালে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে থেকে সরকার গঠন করেছেন । ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটি ছিল একটি চরম রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে অনুষ্ঠিত; যখন বিএনপি ছাড়া সকল রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেছে। এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটও আবার বিএনপি তৈরি করে দিয়েছিল। প্রথমে মাগুরা উপনির্বাচনের নামে এক চরম জালিয়াতি এবং সেই জালিয়াতি এমনই ভয়াবহ ছিল যে স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে সেখান হতে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। অবশ্য সেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বর্তমানে বিএনপির সভা-সমিতিতে গিয়ে জাতিকে নানা বিষয়ে নসিহত করেন। আসলে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই সর্বমহল থেকে দাবি ওঠে দলীয় সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচন হতে হবে একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বেগম জিয়া অনেক টালবাহানার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সকল দলের বর্জন করা সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করায়; যার অধীনে পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি আর জাসদের সমর্থনে সরকার গঠন করে।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে গঠিত সংসদের যে তত্তা¡বধায়ক সরকারের কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছিল তাতে তেমন কোন বড় ধরনের গলদ না থাকলেও ২০০১ সালে সেই কাঠামোতে এক চরম হঠকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়িয়ে আবার পুরো ব্যবস্থাকে এক চরম সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দেয় একই দল বিএনপি। অবসর গ্রহণের এই বয়স বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি ছিল একেবারেই উদ্দেশ্যমূলক; যাতে করে এমন একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন যিনি এক সময় বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। এতে পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে আবার সঙ্কটের মুখে ফেলে দিল এবং আওয়ামী লীগসহ অনেক রাজনৈতিক দল সিদ্ধান্ত নেয়Ñএই ব্যবস্থার অধীনে তারা সংসদ নির্বাচনে যাবে না। তখনও দেশের, দেশের বাইরের অনেক মুরব্বি উপদেশ দিয়ে বলেছিল আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করুন। বিএনপি তা না শুনে দেশকে এক চরম নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, নিয়মনীতি বাদ দিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হন। উপদেষ্টা হিসেবে সঙ্গে নেন কিছু জি-হুজুরি মার্কা ব্যক্তিকে। এরপরও আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দল নির্বাচনে যেতে রাজি ছিল কিন্তু ক’দিন না যেতেই দেখা গেল এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ন্ত্রণের সুতা আসলে বেগম জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের হাতেই। যথারীতি আবার সংঘাত এবং রাজপথ উত্তপ্ত এবং শেষতক সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকারে আবির্ভাব এবং সেই সরকার সংবিধান লংঘন করে দু’বছর ক্ষমতা ভোগ করল। জেলে গেল শেখ হাসিনা আর বেগম জিয়াসহ সকল শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। ২০০৮-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে ।
পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে একটি ব্যবস্থা, যার জন্ম বিএনপির অপরিচ্ছন্ন রাজনীতির কারণে। আবার একই কারণে তাদের তৈরি করা ব্যবস্থাকেও তারা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সুতরাং, আজ বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সঙ্কটের পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে তার জন্য এককভাবে যদিও কাউকে দায়ী করতে হয় তা হলে তা হবে বিএনপি। এরমধ্য এক সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রায় দেয়। তবে এও বলে, প্রয়োজনে এই ব্যবস্থার অধীনে আরও দুই দফা সংসদ নির্বাচন হতে পারে তবে সেখানে প্রধান বিচরাপতির কোন ভূমিকা না থাকাই শ্রেয়। আপাতদৃষ্টিতে এখনও অনেক স্ববিরোধিতা আছে যদিও মূল রায়ে কি আছে তা এখনও জনগণ জানে না। এরই মধ্য সরকার, সরকারী দল সংসদে সংবিধান হতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করেছে এবং বলেছে আগামী নির্বাচন কিভাবে হবে তা নিয়ে সংসদে আলোচনা হতে পারে কিন্তু পূর্বের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আর নয়। এ ব্যাপারে বিরোধী দলের কোন প্রস্তাব থাকলে তা তারা সংসদে এসে উত্থাপন করতে পারে। বিএনপি বলছে, আলোচনা হতে পারে একমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে এবং তা আলোচনার জন্য উত্থাপন করতে হবে সরকারী দল তথা আওয়ামী লীগকেই। এটি অনেকটা ১৯৯৬ সালের অবস্থায় ফিরে যাওয়া। সোজা চোখে দেখলে তখন বিএনপি এই ব্যবস্থার জন্য একটি ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিল যা বর্তমানে অনুপস্থিত। বর্তমান সরকারের আমলে স্থানীয় সরকার হতে সংসদীয় আসন, অনেক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারী দলের প্রার্থীরা হেরেছে। উচ্চ আদালত বলেছে, দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, তারপর কি সকল রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা ফেরেস্তা হয়ে যাবেন? তখন পারলে এখন নয় কেন? পারলে এখনই পারতে হবে এবং তার জন্য কোন জেদাজেদী না করে এখনই একটা পথ খুঁজে বের করতে হবে। এটির জন্য সকলের সদিচ্ছার প্রয়োজন। রাজনীতিতে ধৈর্য এবং পরমতসহিষ্ণুতার প্রয়োজন। এটি সরকারী এবং বিরোধী দল উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অতীতে হঠকারী রাজনীতির কারণে আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। প্রাণহানি ঘটেছে অসংখ্য। সম্পদ হানির কোন সঠিক হিসেব করা কঠিন। সরকার বলেছে বিকল্প পন্থা হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। তার রূপরেখাও সংসদে আলোচিত হবে। আবার বিএনপির সংসদে যেতে চরম অনীহা। রাজনীতিতে এমন আচরণ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়, তাতে শেষে পরাজিত হয় জনগণ।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বলেছেন আলোচনা হবে। আর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল মনে করেন, সেই আলোচনার একটাই বিষয়বস্তু হবে এবং তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনর্বহাল। শর্ত দিয়ে বিশ্বের কোথাও কোন ফলপ্রসূ আলোচনা হয় না। খোলা মন নিয়ে আলোচনা না করলে তা স্রেফ প-শ্রম হয়। চারদলীয় জোট সরকারের আমালে আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এবং আবদুল জলিলের আলোচনা নাটক তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কথায় বলে বাঙালী খাদের কিনারায় গিয়ে আবার ফিরে আসে। দেশের মানুষ আশা করে এবারও তা হবে এবং হবে হিলারি বা প্রণব মুখার্জীর প্রত্যাশার কারণে নয় দেশের মানুষের প্রত্যাশার কারণে। দেশের সমস্যা নিয়ে বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দেয়া চরম মূর্খতার শামিল এবং এমনটি যারা করে তাদের দেশপ্রেম নিয়েও সন্দেহ আছে। যা করতে হয় তা ্এখনই শুরু করা ভাল। সময় চলে গেলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে বাধ্য। খাদের কিনার হতে ফেরার এখনই সময় ।
লেখক : শিক্ষাবিদ এবং বিশ্লেষক । ১১ মে, ২০১২

সোমবার, ৭ মে, ২০১২

উপাচার্যকে সরালেই সব সমস্যার সমাধান হবে না





আগামী অগাস্ট মাসে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আমার শিক্ষকতা জীবনের ৩৯ বছর অতিক্রান্ত হবে এবং এই লেখার যে যৎসামান্য বক্তব্য তা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই। শিক্ষকতার এই দীর্ঘ জীবনে আমার সুযোগ হয়েছে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যতগুলো বিধিবদ্ধ পর্ষদ আছে তার সবগুলোতে নির্বাচিত বা মনোনীত সদস্য হিসেবে কাজ করার। 
১৯৯৬ সালের ৬ নভেম্বর মাননীয় চ্যান্সেলর (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) আমাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালে আমাকে সে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। আমার নির্দিষ্ট মেয়াদ ছিল না, ছিল চলতি দায়িত্ব। উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আমি নিয়মিত ক্লাসও নিয়েছি। আমাকে অপসারণের জন্য কোনো শিক্ষক বা তেমন কোনো ছাত্রসংগঠন আন্দোলন করেনি। তবে আমার কিছু অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন আমাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য শেষের দিকে এসে বিভিন্ন মহলে দেনদরবার করেছেন এবং দৈনন্দিন কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছেন, চ্যান্সেলরের কাছে আমার বিরুদ্ধে চিঠি চালাচালি করেছেন। দায়িত্ব পালনকালে চেষ্টা আমি করেছিলাম সিনেট কর্তৃক উপাচার্যের প্যানেল প্রস্তুত করার, কিন্তু তা সম্ভব হলো না। কারণ এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে দুজন শিক্ষকের একটি মামলা ছিল। মামলাটি ১৯ বার আদালতে তালিকাভুক্ত হলেও শুনানি হয় শেষবার। এর পরপরই আমি উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে পদক্ষেপ নিলে সেই সব ব্যক্তিই আবার এই প্যানেল নির্বাচনের বিরোধিতা করা শুরু করেন, যাঁরা আগে প্যানেল নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। তাঁদের এই স্ববিরোধিতার কারণ ছিল, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যাঁকে বা যাঁদের সামনে নিয়ে তাঁদের এত দিনের আস্ফাালন, তাঁদের পক্ষে এই সিনেট কর্তৃক প্যানেলে নির্বাচিত হওয়া সম্ভব ছিল না। এরপর এক যুগ পার হয়েছে কিন্তু আজ অবধি আমার ওই সব সহকর্মী বন্ধু সিনেট কর্তৃক প্যানেল নির্বাচনের আর দাবি তোলেননি। প্রায়শ আমি বিখ্যাত গজল গায়ক অনুপ জালোটার একটা গজল শুনি, যার প্রথম কয়েকটি লাইন হচ্ছে ‘খঞ্জরসে না কারো বাত, না তালোয়রসে পুছো, মাই কতল হুয়ে কাইসে ও মেরে ইয়ারসে পুচে।’ (আমার হত্যা কী করে হলো তার জন্য ছুরি বা তলোয়ারের কাছে প্রশ্ন করো না, মৃত্যু আমার কেমন করে হলো তা আমার বন্ধুর কাছে জানতে চাও।)
লেখার শুরুতে এত গৌড়চন্দ্রিকা দেওয়ার কারণ বর্তমানে একসঙ্গে দেশের বেশ কটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎ করে ছাত্র-শিক্ষক এবং শিক্ষক-শিক্ষকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অশান্ত হয়ে ওঠা বিষয়ে কিছু কথা আলোচনা করার জন্য। প্রথমে বলে রাখি, সম্প্রতি যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ সময় ধরে অচল হয়ে থাকার পর প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা আবার সচল হচ্ছে, এর জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ। তবে একটি কথা না বললেই নয়। প্রথমে সব সমস্যার সমাধান প্রধানমন্ত্রীকে কেন করতে হবে তা বুঝতে পারি না। বর্তমান মন্ত্রিসভায় যে কজন সফল মন্ত্রী আছেন তাঁর মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী অন্যতম। তাঁর আছে একজন দক্ষ শিক্ষাসচিব। তাঁরা কি এই সমস্যার সমাধান করতে পারতেন না? দ্বিতীয়ত যে পন্থায় এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার আপাতত সমাধান হবে বলে মনে করা হচ্ছে আসলে কি তাই? সার্বিক বিচারে মনে হয় এই আপাতত সমাধান শুরু করে দিতে পারে অনুরূপ সমস্যা অন্য আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে। একজন উপাচার্যকে সরাতে হলে কিছু শিক্ষককে একসঙ্গে হতে হবে, ক্লাস বর্জন করতে হবে, উপাচার্যকে সত্য হোক আর অসত্য হোক সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে তাঁর বাড়ির দুয়ারে অথবা দপ্তরের সামনে শামিয়ানা টানিয়ে ধরনা দিয়ে বসে থাকতে হবে, তারপর এক দিন তাঁদের প্রধানমন্ত্রী তাঁর দপ্তরে বা বাসায় ডেকে নেবেন, তাঁদের দাবিগুলো ধৈর্যসহকারে শুনবেন এবং সব শেষে আশ্বাস দেবেন তিনি চ্যান্সেলরকে বিষয়গুলো জানাবেন এবং তিনি সেভাবে ব্যবস্থা নেবেন অর্থাৎ উপাচার্যকে সরিয়ে আরেকজনকে নিয়োগ দেবেন। সবাইকে বলি, পরের জনের অবস্থাও যে আগের জনের মতো হবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? চ্যান্সেলরকে একটা বিনীত অনুরোধ করতে চাই। যাঁরা একজন উপাচার্যকে সরাতে আন্দোলন করেন পরবর্তী উপাচার্য তাঁদের মধ্য থেকেই একজনকে করা হোক। এরপর যখন কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক যদি তাঁর বিভাগীয় প্রধানকে মানি না বলে তাঁর বাড়ির সামনে শামিয়ান টানান তখন কী হবে?
সংবাদপত্র খুললেই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ’অনিয়মের’ কথা শোনা যায়। যাঁরা এসব সংবাদ তৈরি করেন তাঁদের অনেকেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে চলে সেসব আইন-কানুন সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখেন না। প্রায়ই ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের কথা বলা হয়। দেশের ৩৩-৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আইন বলবৎ আছে। বাকিগুলোর উপাচার্য নিয়োগ একান্তভাবে চ্যান্সেলরের। অনেকে মনে করেন, নির্বাচিত উপাচার্য থাকলে সব সমস্যার সমাধান হবে। তাঁদের কাছে একটা প্রশ্ন করকে চাই, ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট তিনজন উপাচার্যের প্যানেল নির্বাচিত করেছিল। তার মধ্যে যাঁকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তিনি সর্বোচ্চ একাত্তর ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর মতো পণ্ডিত ব্যক্তি তখনো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি ছিল না, এখনো নেই। সেই উপাচার্যকে ১৯৯১ সালে বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে একটি ছাত্র সংগঠন ও কিছু শিক্ষকের দাবির মুখে ১৮৯৭ সালের একটি আইনের বলে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এরশাদের পতন হলে ছাত্র-শিক্ষকদের একটি বিজয় র‌্যালিতে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন ‘একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীরা নব্বইয়ে বিপ্লবী সেজেছে, তাদের কাছ হতে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়কে অচল করেছে, উপাচার্যকে সপরিবারে তাঁর সরকারি বাসভবনকে সাব জেল ঘোষণা করে গ্যাস-বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন রেখে ১২ দিন বন্দী করে রেখেছে। একপর্যায়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বদরুদ্দোজা চৌধুরী উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করলেন, উপাচার্যকে বললেন, ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী পদত্যাগ করতে। তা করতে তিনি অস্বীকার করলেন। শিক্ষকেরা ছাত্রদের অবরোধ ভেঙে ক্লাস নিতে গেলে ধর্মঘটী ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাঁদের ওপর হামলা করে অনেক বিশিষ্ট শিক্ষককে রক্তাক্ত করে, মেধাবী ছাত্র ফারুকউজ্জামান ফারুককে হত্যা করে। এদের অনেকেই এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পরে শিক্ষকেরা চট্টগ্রাম শহরের একটি বেসরকারি কলেজে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে পুরো বিষয়টি নিয়ে সরকারের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন। পুরো ঘটনা তদন্ত করার জন্য তৎকালীন চ্যান্সেলর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এক সদস্যবিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেন এবং সেই কমিটি তদন্তপূর্বক এক অদ্ভুত প্রতিবেদন দাখিল করে যার উপসংহারে লেখা ছিল ‘এই উপাচার্যকে রেখে সমস্যার সমাধান হবে না এবং তাঁকে সরিয়েও সমস্যার অবসান হবে না।’ সেই বিচারপতি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। সেই প্রতিবেদনের আলোকে চ্যান্সেলর ধর্মঘট সমর্থক এবং বিরোধী পক্ষ—উভয় পক্ষের শিক্ষকদের তাঁর দপ্তরে ডেকেছিলেন। এই লেখকেরও সেই সভায় উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে চ্যান্সেলর মহোদয় অনেক কথা বলেছিলেন, যার প্রত্যেকটা কথা আমার ডায়রিতে লেখা আছে। তিনি বলেছিলেন, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন কোনো আদালতের রায় নয় এবং তা মানতে সরকার বাধ্যও নয়। 
বেগম জিয়া ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে ১১ জন নির্বাচিত এবং মনোনীত উপাচার্য, উপউপাচার্য ও ট্রেজারারকে ১৮৯৭ সালের সেই আইন দিয়ে তাঁদের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলন। তখন কিন্তু আজকে যাঁরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করছেন, তাঁদের কেউ টুঁ শব্দটি করেননি। এটি অবশ্যই বলতে হবে, যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে তখনই অন্য আর দশটি জায়গার মতো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও প্রায় ক্ষেত্রে অচল অবস্থা সৃষ্টির সুযোগ প্রথমে করে দিয়েছে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু অছাত্র এবং কিছু বর্ণচোরা আওয়ামী লীগ সমর্থক। যারা প্রত্যেকে মনে করেছে বর্তমান উপাচার্য নয়, তাদের কেউ একজন উপাচার্য হওয়া উচিত ছিল। তাদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার জন্য অনেক সময় অত্যন্ত অনৈতিকভাবে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করেছে। 
জাহাঙ্গীরনগর বা বুয়েটে যে কারণে সবার সম্মিলিত প্রয়াসে এত দিন পড়ালেখা বন্ধ ছিল তার দায়ভার তো শিক্ষকদেরই নিতে হবে। প্রথমে বলে নিই, এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে আমার তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। বুয়েটের উপাচার্যকে একটু বেশি চেনার সুযোগ হয়েছে। কারণ, আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য পরিষদের সভাপতি ছিলাম, তখন তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। জাহাঙ্গীরনগরের ড. শরিফ এনামুল কবিরের সঙ্গে একবার একটা সেমিনারে দেখা হয়েছে। শুনেছি তিনি পণ্ডিত ব্যক্তি। বুয়েট এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যাকে নিয়ে দেশের মানুষ গর্ব করে। তেমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করার সব আয়োজন বলতে গেলে শুরু হয়েছে। এটি জাতির জন্য একটি চরম দুর্ভাগ্য। 
পত্রিকায় লেখা হয়, বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কথাটি সত্য, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিজ্ঞাপন দেওয়া এবং নিয়োগ-প্রক্রিয়া শেষ করার মধ্যে প্রায়ই দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। এর মধ্যে অনেক শিক্ষক অবসরে যান, কেউ কেউ শিক্ষা ছুটিতে। পদ খালি হয়। কোনো কোনো সময় নতুন বিভাগও খোলা হয়। আবার কোনো সময় সরকারের আদেশের কারণে সব নিয়োগ-প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগে দীর্ঘ ১১ বছর শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ ছিল। অন্যটিতে সাত বছর। 
তবে একটা কথা না বললেই নয়, কোনো উপাচার্যেরই কখনো কোনো ছাত্রসংগঠনকে তাঁর উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। সব শেষে বলি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হটাও আন্দোলনের সময় কোনো কোনো সাংসদ সেখানে গিয়েছেন। তা ঠিক বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত ছিল না। একজন উপাচার্যের শুধু পাণ্ডিত্য থাকলেই হবে না, তার সঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অপরিহার্য। তা একাডেমিক এবং প্রশাসনিক। টিকে থাকুক আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এগুলো সাধারণ ছাত্রছাত্রীদেরও শেষ ভরসাস্থল। এখান থেকেই তৈরি হবে আগামী দিনের নেতারা, যাঁরা দেশ-সমাজ আর জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। মহামান্য চ্যান্সেলর কী করেন তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম। এ বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার একান্তভাবে তাঁর।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

রবিবার, ৬ মে, ২০১২

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিকল্প গণমাধ্যম


                                                                আবদুল মান্নান

বাংলাদেশের যাঁরা বর্তমানে রাজনীতি করেন তাঁদের অনেকেই ভুলে যান যে তাঁরা একবিংশ শতকে রাজনীতি করছেন এবং সেই রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে গণমাধ্যম একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। আবার গণমাধ্যম বলতে শুধু সংবাদপত্র, রেডিও বা টিভির মধ্যে সীমাবদ্ধ, তা কিন্তু নয়; বর্তমানে বিকল্প গণমাধ্যম (Alternative Media) নামে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি গণমাধ্যমের আবির্ভাব হয়েছে, যা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম নয়। এই বিকল্প গণমাধ্যমের ব্যাপ্তি সাধারণ গণমাধ্যমের চাইতে অনেক বেশি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রভাব বিশ্বব্যাপী পৌঁছানোর ক্ষমতা অনেক ব্যাপক। দু’টি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। বছর দুই আগে আমার সুযোগ হয়েছিল অনলাইন রেডিওর একটি টকশোতে অংশগ্রহণ করতে। এর আগে জানা ছিল না অনলাইন রেডিও জিনিসটা কি। গিয়ে দেখি রেডিও স্টুডিওটার আয়তন একটি মাঝারি সাইজের বাথরুমের মতো। দু’টি কম্পিউটার আর দু’টি চেয়ার। একটিতে রেডিও জকি (সঞ্চালক) বসেন অন্যটিতে অংশগ্রহণকারী। এটি ছিল আমাদের বিজয় দিবস উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান। কথার ফাঁকে ফাঁকে গান। তখন বেলা সাড়ে বারোটা। আমি দু’টি বাক্য বলতেই প্রথম মেলটি এলো সুদূর ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি হতে। ওদিক হতে একজন শ্রোতা জানাল, অনেকদিন পর সে আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে বেশ আনন্দিত। এরপর একটি গান। অবাক করে পরের মেলটি মিসরের রাজধানী কায়রো হতে। এমন রেডিও যে কেউ তার বাড়ি বা অফিসে বসে খুলতে পারে। খোলার সহজ উপায়ও গুগল সার্চ ইঞ্জিনে পাওয়া যাবে।
পরের ঘটনা গত ১ মের। এদিন ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মহান মে দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বক্তব্য রাখছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান। সাধারণত তাঁকে কোন সভায় বক্তৃতা দিতে তেমন একটা দেখা যায় না। অনেকটা নিভৃতচারী। তাঁর বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি বিএনপির নিখোঁজ হওয়া নেতা ইলিয়াস আলী সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে ‘বিধবা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং বলেন ইলিয়াস আলীর খুনী কে তা যেন তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জানান। তিনি তাঁর বক্তব্য দেয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশ এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যায়। কারণ এখন প্রায় সকল মোবাইল ফোনেই ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া থাকে। ঘটনা শুধু এখানেই থেমে থাকেনি। রাতের খবরে মুন্নুজান সুফিয়ানের এই বক্তব্য কয়েকটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে বিস্তারিত দেখাল এবং মুহূর্তের মধ্যে তা ইউটিউবে আপলোড হয়ে ফেসবুকের মাধ্যমে সবখানে ছড়িয়ে গেল। আমি সংবাদ দেখার আগেই আমার বন্ধু শহীদ যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেস হতে ফোন করে আমাকে অনেকটা ধমক দিয়ে ক্ষোভের সঙ্গে বলল, কী বলে তোমাদের এসব মন্ত্রী? আমি তো অনেকটা লা-জওয়াব। শহীদ একাত্তরের একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধুর একজন বড় মাপের ভক্ত। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে এগুলো হচ্ছে বিকল্প গণমাধ্যমের নমুনা। আমাদের বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ আধুনিক বিজ্ঞানের এই দিকগুলো বুঝতে অক্ষম। কারণ তাঁরা এখনও প্রস্তর যুগে বাস করেন আবার এদের অনেকেই বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায় অথবা দলীয় নেতৃত্বে আছেন। আমি এক শ’ ভাগ বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী একজন ডিজিটাল যুগের মানুষ এবং তাঁর ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় একজন প্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ, কিন্তু তাঁর চারপাশে এসব প্রস্তরযুগের এনালগ মানুষ নিয়ে তিনি কিভাবে কাজ করবেন? প্রধানমন্ত্রীর সভাপারিষদ বা পরামর্শদাতার কেউ কেউ তাঁকে পরামর্শ দিতে পারেন, বন্ধ করে দিন এসব ঝামেলা । তাদের বলি তা করা খুব সহজ নয় । প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একবার ফেসবুকে কি এক ব্যঙ্গচিত্র প্রচারিত হয়েছিল। কারা বুদ্ধি দিল বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ থাকবে । তাতে কি কোন কাজ হয়েছিল? না, হয়নি । কারণ নিমিষেই যাদের এই ব্যাপারে আগ্রহ আছে তারা বিকল্প পথে তা আবার চালু করেছিল ।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক তাঁর ফেসবুকে একটি কার্টুন প্রচার করেছে । মমতার হুকুম গ্রেফতার কর সেই বেয়াড়া অধ্যাপককে। জো হুকুম বলে পুলিশ সেই অধ্যাপকের হাতে হাতকড়া পড়াল । তাতে লাভ হলো এটাই এখন মমতাকে নিয়ে ফেসবুকে অসংখ্য কার্টুন; যার অধিকাংশের উৎপত্তি হয়ত ভারতবর্ষের বাইরে। ইদানীং ফেসবুকে ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান নিয়ে একটি মজার সিনেমার পোস্টারের আদলে ফটোসপে করা একটি স্থিরচিত্র প্রচারিত হচ্ছে। পোস্টারটির বামপাশে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গায়ে কালো কাপড়। হাতে একটি আধুনিক পিস্তল। অনেকটা সঞ্জয় দত্ত স্টাইলে। ডানপাশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব স্যুটপরা মির্জা ফখরুল। তিনি নিজের টাই ঠিক করছেন। নিচে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুুবুল আলম হানিফ। ছবির নাম ‘খোঁজ’ ইংরজী নাম ঞযব ঝবধৎপয. নিচে লেখা সকল টিভি চ্যানেলে চলিতেছে। এই পোস্টার নিয়ে অসংখ্য মন্তব্য। কিভাবে ঠেকাবেন এসব বিকল্প গণমাধ্যম ? বা তা ঠেকানোর কোন প্রয়োজন আছে কি ? একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় গণমাধ্যমকে বলা হয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। ওটির ওপর অযাচিতভাবে হাত দেয়ার অর্থ গণতন্ত্রের ওপর হাত দেয়া । পাঠক, ঠিক করবে কোন্টি বস্তুনিষ্ঠ আর কোন্টি নয়। আমি খুব কম জামায়াত সমর্থককে দেখেছি দৈনিক সংগ্রাম পড়তে অথবা বিএনপিপন্থীদের দেখেছি দৈনিক দিনকাল কিনতে। কোন পত্রিকা বা গণমাধ্যম গুজবের জন্ম দিলে বা অসত্য তথ্য প্রকাশ করলে তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য দেশে অনেক আইন আছে। বন্ধ করে দেয়া কোন সমাধান নয়।
ইদানীং বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ান নামক একটি পত্রিকা নিয়ে হৈচৈ হচ্ছে। তার কারণ এই পত্রিকায় বাংলাদেশ, বর্তমান সরকার, সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা এবং সরকারের শীর্ষ পদে থাকা কিছু নেতানেত্রীকে নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে; যার প্রায় সবটুকুই কল্পকাহিনী। এ নিয়ে আবার আমাদের দেশের কোন কোন সংবাদপত্র শ্রীলঙ্কায় আমাদের দূতাবাসের বরাত দিয়ে জানানোর চেষ্টা করেছেÑওই নামে শ্রীলঙ্কা হতে কোন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় কি-না । খোঁজ নিয়ে তারাও বলেছে, না, হয় না। আমাদের কোন কোন বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী এ নিয়ে আবার পত্রপত্রিকায় দু’একটি কলামও লিখে ফেলেছেন। নিয়মিত এই পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ কোন কোন বেসরকারী টিভি চ্যানেলের মধ্যরাতের টকশোর আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে। বিদগ্ধ কলাম লেখক এবং সমাজবিজ্ঞানী বদরুদ্দীন উমরের মতো একজন প-িত ব্যক্তিও এই পত্রিকায় বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর প্রকাশিত মন্তব্য নিয়ে ২৯ এপ্রিলের দৈনিক যুগান্তরে একটি কলাম লিখে ফেললেন এবং সরকারের কাছে দাবি করেনÑ সেই পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের ওপর সরকারকে ব্যাখ্যা দিতে হবে। জানি, আমার মতো একজন অধম বদরুদ্দীন উমরের মতো একজন উত্তম প-িত ব্যক্তির লেখা নিয়ে মন্তব্য করলে কোন কোন পাঠক আমাকে হয় একজন বড় মাপের মূর্খ ভাববেন অথবা মনে করবেন একজন চরম বেয়াদব। তারপরও সকলের জ্ঞাতার্থে বলতে হয়Ñএই পত্রিকাটা আছে, তবে তা কোন কাগজে ছাপা পত্রিকা নয়; ওটি ওয়েবপোর্টালে প্রকাশিত পত্রিকা এবং তা খুব সহজেই বিশ্বের যে কোন প্রান্ত হতে প্রকাশ করা যায় এবং তার জন্য কোন সরকারী অনুমোদন নিতে হয় না। ইচ্ছা করলে আমি বা জনাব বদরুদ্দীন উমর যে কেউ এমন একটা পত্রিকা এই ঢাকায় বসে প্রকাশ করতে পারি এবং তাতে সরকারের বিরুদ্ধে মনের মাধুরী মিশিয়ে যা ইচ্ছা তা লিখতে পারি। এবং এই কাজগুলো করতে পারি অত্যন্ত গোপনে, এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্যে বসেও। এগুলো হচ্ছে বিকল্প গণমাধ্যম। ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে অন্যকে ঘায়েল করতে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র। গত দু’দিন ধরে শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ান পত্রিকাটি বাংলাদেশে অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে না। তা বলে কি উৎসাহী পাঠক সে পত্রিকা পড়া বন্ধ রেখেছেন? মোটেও না। বিদেশ হতে অসংখ্য ব্লগার তাদের ব্লগে বাংলাদেশ বিষয়ক ফিচারগুলো তাদের ব্লগে আপলোড করে দিচ্ছেন। এটি সঠিক অর্থে বন্ধ করতে হলে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি কম্পিউটার বঙ্গোপসাগরে ফেলে আসতে হবে।
এবার আসি বেসরকারী কোন কোন মধ্যরাতের টকশোতে এই ধরনের বিকল্প গণমাধ্যম নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে। একটি কথা না বললেই নয়। এটি বললে হয়ত কেউ কেউ মনোক্ষুণœ বা আমার ওপর বিরক্ত হতে পারেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম, সেটি প্রিন্ট মিডিয়া হোক বা ইলেকট্রনিক মিডিয়াÑ সব সময় আওয়ামী লীগ বিরোধী কিছু প্রচার করতে পারলে এক ধরনের আনন্দ অনুভব করে। প্রত্যেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কিছু নতুন পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের অনুমোদন দেয়া হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এগুলোর অধিকাংশই হাত বদল হয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী ভাবাপন্ন কারও হাতে চলে যায় এবং তা আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করার জন্য যথেচ্ছভাবে তারা তা ব্যবহার করে এবং তাদের এই ধরনের অনুষ্ঠানে অনেক ক্ষেত্রেই বস্তুনিষ্ঠতার প্রচ- অভাব থাকে। আবার মধ্যরাতের টকশোগুলোতে দেখা যায় প্রায়শ যে সকল ব্যক্তিকে সরকার বা সরকারী দলের পক্ষে কথা বলার জন্য আনা হয় তাদের অধিকাংশই এত মধ্যমেধার ব্যক্তি হন যে, মাঝে মাঝে মনে হয় তাদের পেটে বোমা মারলেও একটা কথা বের হবে না। ক’দিন আগে একটি টিভি চ্যানেলে আলোচনায় শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ান প্রসঙ্গ আনলেন বিএনপির এক নেতা। অন্যদিকে ছিলেন আওয়ামী লীগদলীয় একজন মোটামুটি শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। সেই নেতা শুধু আমতা আমতাই করলেন। দর্শকদের আশ^স্ত করতে কিছুই বলতে পারলেন না। সরকারী কলেজের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপককে ডাকা হয়েছিল বিটিভির একটি টকশোতে। আলোচনায় এসে গেল হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশে সফর প্রসঙ্গে। সেই অধ্যাপক বললেন, এই সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাজার হোক হিলারি ক্লিনটন তিন তিনবার যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্টলেডি ছিলেন! সেই অধ্যাপক জানেন না, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ২২তম সংশোধনী (১৯৪৭ সালে গৃহীত) অনুযায়ী কারও পক্ষে তিনবার প্রেসিডেন্ট হওয়া যেমন সম্ভব নয় তেমনিভাবে কেউ তিনবার ফার্স্টলেডিও হতে পারেন না। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একমাত্র ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট তিনবার প্রেসিডেন্টের পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। চতুর্থবারের মাঝপথেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
বর্তমানে বাংলাদেশে যত রকমের বিকল্প মিডিয়া আছে তার প্রায় সবই ব্যবহৃত হচ্ছে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে দেশে এবং দেশের বাইরে জনমত সৃষ্টি করার জন্য এবং এর জন্য জামায়াত কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। একজন সাবেক আমলা যিনি আওয়ামী লীগের প্রথম সরকারের আমলে (১৯৯৬-২০০১) গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন যাঁর বয়স বর্তমানে সত্তরোর্ধ, তিনি এই কাজে যে পরিমাণের সময় ব্যয় করেন তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বিকল্প গণমাধ্যম একটি বাস্তব সত্য এবং এটি বন্ধ করা সম্ভব নয়। যোগ্য লোক দিয়ে এটির ব্যবহারের কোন বিকল্প সরকারের কাছে নেই। শুধু ডিজিটাল ডিজিটাল বললেই বাংলাদেশ ডিজিটাল হয়ে যাবে না। তা করতে হলে যোগ্য লোকের হাতেই অনেক দায়িত্ব সরকারকে ছেড়ে দিতে হবে। আর তা যদি সরকার দ্রুত করতে না পারে তা হলে সরকারের অনেক অর্জন ভেস্তে যাবে।
মুন্নুজান সুফিয়ান একজন অত্যন্ত সৎ এবং ত্যাগী আওয়ামী লীগ কর্মী তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে তিনি মন্ত্রিসভায় না থাকলে কি সরকারের কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে? একজন নয়, বর্তমান মন্ত্রিসভায় মুন্নুজান সুফিয়ান আরও আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে ছাড়া মনে হচ্ছে বাংলাদেশের কোন সমস্যাই সমাধান হচ্ছে না। দেখবেন নাকি একবার আপনার মন্ত্রিসভার দিকে তাকিয়ে? আমার মন্তব্যে মনোক্ষুণœ হতে পারেন। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমরা আবার বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের আমলে ফিরে যেতে চাই না। আবার দেখতে চাই না আমিনী-সাঈদীদের তা-ব।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক। ৪ মে , ২০১২