মঙ্গলবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১২

আশুলিয়া ও চট্টগ্রাম ট্র্যাজেডি: সতর্ক না হলে আরও লাশ গুনতে হবে

 আবদুল মান্নান | তারিখ: ২৮-১১-২০১২

একই দিনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি ভিন্ন ভিন্ন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ১২৩ জন মানবসন্তান প্রাণ হারালেন। প্রথম দুর্ঘটনাটির অকুস্থল ঢাকার অদূরে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে, যেখানে সন্ধ্যায় আগুন লেগে এই পর্যন্ত ১১১ জন গার্মেন্টস-কর্মী পুড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই সংখ্যা বাড়তেও পারে। এটি দেশের গার্মেন্টস কারখানায় সংঘটিত এযাবৎকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের ব্যস্ততম ও জনবহুল এলাকা বহদ্দারহাটে সন্ধ্যা সাতটার কিছু পরে, যখন সেখানে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের দুটি কংক্রিট নির্মিত গার্ডার ধসে পড়ে ১২ জন পথচারী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে মুহূর্তেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিল। এই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে এখনো বেশ কয়েকজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।
কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্বব্যাংকসহ একাধিক আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশংসাসূচক ইতিবাচক সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রচারিত হচ্ছিল এবং এতে সরকার তো বটেই, দেশের মানুষও বেশ উজ্জীবিত হয়েছিল। এই মর্মান্তিক ঘটনা দুটির কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও কিছুটা হলেও ক্ষতি হয়েছে এবং সরকারকেও বেশ বিব্রত করেছে। যদিও প্রথম ঘটনাটির জন্য সরকারকে সরাসরি দায়ী করা সমীচীন হবে না। এ দুটি ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সরকারের আহ্বানে দেশের মানুষ মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে। এই দুই ঘটনায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং তাঁদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের জন্ম এবং তার বিস্ময়কর উত্থান রূপকথার মতো। ১৯৭৬ সালে একজন ডাকসাইটে আমলা এবং একাত্তরের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা নুরুল কাদের খানের হাত ধরে জন্ম নেওয়া এই শিল্প এখন বাংলাদেশের ৪১ বছরের অনেক সফলতার একটি অসাধারণ কাহিনি। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত নুরুল কাদের খানের ‘দেশ’ গার্মেন্টস থেকে প্রথম চালানে আনুমানিক ১২ হাজার ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল। এই খাতে আমাদের এখন রপ্তানি ১৯ বিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাকশিল্পে চীনকে বাদ দিলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক প্রস্তুতকারী দেশ। মাঝখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আছে, তবে এই ইউনিয়নে ২৭টি দেশ অন্তর্ভুক্ত। দেশের ৭৮ ভাগ রপ্তানি খাতের আয় এই শিল্প জোগান দেয়, আর এই শিল্পে কাজ করেন প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিক, তাঁদের ৯০ ভাগই হচ্ছেন নারী শ্রমিক। দেশে এখন প্রায় ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান চালু আছে, যার বেশির ভাগই বৃহত্তর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে আরও অনেকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বলতে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য তৈরি পোশাকশিল্প এখন সোনার ডিম পাড়া হাঁস।
চীন বিশ্বের বৃহত্তম তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও সে দেশও এখন সীমিত আকারে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি শুরু করেছে, আর অনেক আন্তর্জাতিক ক্রেতা চীন বা অন্যান্য দেশের পরিবর্তে বাংলাদেশকে তাদের ক্রয়ের উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছে। কারণ, মজুরি কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশের পোশাক আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। বলতে দ্বিধা নেই, তেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে আমরা সঠিকভাবে লালন করতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি। যার অন্যতম হচ্ছে শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিম্নতম মজুরির নিশ্চয়তা। অথচ কোনো সরকারই এই খাতকে সুযোগ-সুবিধা দিতে কার্পণ্য করেনি।
নব্বইয়ের দশকে প্রথম বাংলাদেশের এই শিল্প ধাক্কা খায় যখন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলো এই মর্মে তাদের দেশের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যে যেহেতু বাংলাদেশ এই শিল্পে শিশুশ্রম ব্যবহার করে, সেহেতু তাদের উৎপাদন খরচ যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খরচ থেকে কম। অতএব, সে দেশ থেকে পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে। এই মর্মে মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিলও উত্থাপন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সতর্ক হলে সেটি আর কার্যকর হয়নি। নির্ধারিত ও প্রত্যাশিত নিয়মকানুন ঠিকমতো মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য আগে বিদেশি ক্রেতার এই দায়িত্বটা দিয়েছিল তাদের এদেশীয় এজেন্টদের। ক্রমে তারা এখন নিজেরাই বাংলাদেশে পরিদর্শকের দপ্তর খুলে বসেছে। কারণ, তারা আর আমাদের বিশ্বাস করতে পারছে না। এসব পরিদর্শক যেকোনো সময় তাঁদের অর্ডারের পোশাক তৈরি করছে তেমন যেকোনো কারখানায় প্রবেশ করতে পারেন, লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, করণীয় কর্তব্যেও ব্যত্যয় ঘটলে বাতিল করে দিতে পারেন চালান। এত সব কারণের পরও ঘটে যেতে পারে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের ঘটনার মতো একটি মর্মান্তিক ঘটনা। এই দেশে গত দুই দশকে এমন ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন এক হাজারের মতো মানুষ, বিচার হয়নি কারও। কারণ, যাঁরা এসব কারখানার মালিক, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দলের প্রতি তাঁদের অনেকের আনুগত্যও বদলে যায়। সরকারের সঙ্গে থাকলে অনেক পাপ করেও পার পাওয়া যায়।
গত রোববার রাতে বিজিএমইএর একজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা একাধিক টিভি চ্যানেলে এসে এ ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা করলেন এবং বললেন, যে কারখানাটিতে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে, তারা সব নিয়মকানুন মেনেই চলে। তাঁর ভাষায়, ওই কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থা সন্তোষজনক ছিল। নিরাপত্তাব্যবস্থা সন্তোষজনক থাকলে কেমন করে ঘটল এমন একটি দেশ কাঁপানো ঘটনা? গলদটা কোথায় ছিল? এখন দেখা যাচ্ছে, এই কারখানাটিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় ক্রেতা ‘উচ্চপর্যায়ের’ ঝুঁকিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছিল। আসলে নিরাপত্তাব্যবস্থার সংজ্ঞার মধ্যে বড় ধরনের ত্রুটি আছে। একসময় আমি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতাম। আমাদের ছাত্রাবাসটি ছিল ১২ তলা। প্রতি চার মাস অন্তর সেখানে কোনো নোটিশ না দিয়ে দমকল বাহিনী এসে মধ্যরাতের কোনো এক সময় ভবনের আগুন সতর্কীকরণ অ্যালার্ম বাজিয়ে দিত। নিয়ম ছিল, সবাই তাদের দরজা খোলা রেখে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসবে। এক ঘণ্টা সময়। তারপর তারা প্রতিটি কক্ষে গিয়ে তল্লাশি চালাত, কেউ ঘুমিয়ে আছে কি না। সব ঠিকঠাক থাকলে আমরা আবার নিজ কক্ষে ফিরতে পারতাম। তখন হয়তো ভোর হয় হয়।
তাজরীন ফ্যাশনসে সেদিন সময়মতো অ্যালার্ম বেজেছিল। শ্রমিকেরা বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে সবাইকে বলা হলো, ওই অ্যালার্ম কিছু না। ওটি এমনি এমনি বাজছে। একটু পরে তা বন্ধ হয়ে যাবে। এই বলে তাঁরা ভবন থেকে বের হওয়ার গেটে তালা লাগিয়ে দেন, যা নিরাপত্তার দৃষ্টিতে একটি অমার্জনীয় অপরাধ। নিরাপত্তাব্যবস্থা ৩৬০ ডিগ্রি হওয়া একান্তভাবে অপরিহার্য। এর অর্থ হচ্ছে, কোনো একটি ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকলে চলবে না। একটি কারখানায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা হয়তো আছে, কিন্তু সে সম্পর্কে সবার যথেষ্ট ধারণা না থাকলে ঘটে যেতে পারে তাজরীন ট্র্যাজেডি। শিল্পকারখানায় আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থার অন্যতম প্রযুক্তি হচ্ছে, যেখানে দাহ্য পদার্থ থাকে অথবা যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে কাজ করে সেখানকার সিলিংয়ে পানির স্প্রিংক্লারের ব্যবস্থা থাকা। অনেক হোটেলকক্ষেও এই ব্যবস্থা থাকে। এই স্প্রিংক্লারের মুখে একধরনের মোম থাকে। রুমের তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করলে সেই মোম আপনাআপনি গলে যায় এবং সিপ্রংক্লার থেকে পানি ছিটানো শুরু হয়। এবং একই সঙ্গে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করে। প্রতি ফ্লোরে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকা অবশ্যই নিরাপত্তার জন্য একটি অপরিহার্য বিষয়। শুধু তা থাকলে হবে না, তা প্রতিনিয়ত মনিটর করতে হবে। এসব ব্যবস্থা চালু করা খুব ব্যয়বহুল বিষয় নয়, শুধু মালিকদের একটু সদিচ্ছার প্রয়োজন।
কারও কারও দ্বিমত থাকতে পারে, গার্মেন্টস কারখানা পুড়লে, মানুষ মারা গেলে মালিকদের ক্ষতি নেই। তাঁদের কারখানার বিমা আছে। একটি কারখানায় লগ্নি করা পুঁজি তুলে আনতে বেশি হলে সাত বছর সময় লাগে। আগুনে পুড়লে ব্যাংক থেকে ধার করা ঋণ মওকুফ পাওয়া যায়, তা না হলে ঋণের সুদ মাফ পাওয়া যায়। ক্ষতি হয় দেশের আর সেই সব শ্রমিকের, যাঁরা নিজেদের সবকিছু উজাড় করে মালিকদের মালয়েশিয়া আর দুবাইতে সেকেন্ড হোম ক্রয়ের অর্থ জোগান। এসবের মধ্যেও ব্যতিক্রম আছে। বছর কয়েক আগে আমি আমার এক প্রাক্তন ছাত্রের একটি বড় কারখানা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম কয়েকজন বিদেশি অতিথিকে। তাঁরা সম্পূর্ণ ব্যবস্থা দেখে মন্তব্য করেছিলেন, এই মানের কারখানা খোদ ইউরোপেও খুব বেশি নেই।
পুলিশ ধারণা করছে, আশুলিয়ার ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। রোববার আশুলিয়ার ‘ডেভোনিয়ার’ গার্মেন্টসে আগুন দেওয়ার চেষ্টাকালে সুমি বেগম নামের একজনকে পুলিশ আটক করেছে। তিনি বলেছেন, তাঁর সহকর্মী জাকির হোসেন তাঁকে ২০ হাজার টাকায় এই কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। তেমনটি হলে পুরো বিষয়টি অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে। ডিসেম্বর মাসে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের যে বিচার হচ্ছে, তা বানচাল করার জন্য বেশ কিছু বড় ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা। সোমবার উত্তরার দক্ষিণখানে আরও একটি গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লাগল। আশুলিয়া দুর্ঘটনা তদন্তের জন্য সরকার একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। দেশের মানুষ আশা করে, তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে এবং এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হবে।
চট্টগ্রামের ঘটনা আমার নিজ শহরের ঘটনা। স্বল্প পরিসরে এটির সঠিক ব্যাখা-বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। তবে এখানে শুধু এতটুক বলতে পারি, কেবল দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য লোকদের হাতে পড়লে সিডিএর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কী দশা হতে পারে চট্টগ্রাম ট্র্যাজেডি তার একটি বড় উদাহারণ। একই কথা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বেলায়ও সত্য। নির্মম পরিহাস হচ্ছে, এই দুই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারই রাজনীতিতে অভিষিক্ত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাত ধরে। তাঁর অনেক গুণ আছে। তবে তাঁর বড় দুর্বলতা, তিনি সব সময় সঠিক মানুষ চিনতে ভুল করেছেন। এই বিষয়ে অন্য আরেক দিন লেখার ইচ্ছা রইল।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১২

পদ্মা সেতু বিতর্ক কি পূর্বপরিকল্পিত?


আবদুল মান্নান

শুরুতে বলে নিই, আমার এই লেখা বিশ্বব্যাংক-পদ্মা সেতু বিতর্কে সরকারের পক্ষে কোনো সাফাই গাওয়ার জন্য নয়। আর সরকারের পক্ষে সাফাই গাইলেও তা কেউ শুনবে না। কারণ, বিশ্বব্যাংকের ঢোলের আওয়াজ অনেক বড় এবং সে ঢোলে যখন বিশ্বব্যাংক বাড়ি দেয়, তখন তা এ দেশের মানুষ অনেক বেশি শোনে। এ দেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের অনেকেই সঠিকভাবে জানেন না বিশ্বব্যাংক আসলে কাদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং কোন কোন দেশ তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
বাংলাদেশের বহুপ্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু নির্মাণের পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির চেষ্টা হয়েছে—এ অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবে না বলে সরকারকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তারা এ দুঃসংবাদটি দিয়েছে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের এ ব্যাপারে চুক্তি হওয়ার ১৪ মাস পর। ফলে সরকারের তো বটেই, দেশের ভাবমূর্তিরও বড় ক্ষতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের যে অর্থ থেকে আপাতত বাংলাদেশ বঞ্চিত হলো, তা সহজ শর্তে ঋণ ছিল। একসময় দেশের জনগণকেই এই অর্থ সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হতো। পুরো বিষয় নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে বেশ হইচই হচ্ছে। বিরোধীদলীয় নেতা এই ‘অপরাধ’-এর কারণে সরকারেরই পদত্যাগ দাবি করেছেন। এটিও একটি নজিরবিহীন ঘটনা। পাশের দেশ ভারতে এমন একটি ঘটনা ঘটলে বিরোধী দল আর সরকারি দল একসঙ্গে বসে একটি কর্মপন্থা ঠিক করার চেষ্টা করত। ঠিক একই অজুহাতে বেগম জিয়ার আগের সরকারের আমলে বিশ্বব্যাংক একাধিক প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছিল; কিন্তু তা নিয়ে তেমন হইচই হয়নি। কারণ, সেসব প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের দেয় অর্থের পরিমাণ অনেক কম ছিল। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, বেগম জিয়া ও তাঁদের সভা পারিষদেরা কয়েক দিন ধরে বলে আসছেন, তাঁরা ক্ষমতায় গেলে একটি নয় দুটি পদ্মা সেতু বানাবেন। রাজনীতিতে বাগাড়ম্বর বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়, তবে তারও একটা সীমা থাকা উচিত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জেনারেল জিয়া, বিচারপতি সাত্তার এবং বেগম জিয়া বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ১৭ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তাঁরা কেন পদ্মার ওপর সেতু বানানোর চিন্তা করেননি, তা জনগণ জানে না। আর পদ্মার ওপর দুটি সেতুর আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, তা অর্থনৈতিক ও কারিগরি সমীক্ষার ব্যাপার। যাক সেসব কথা।
পদ্মার ওপর একটা সেতু হওয়ার প্রয়োজন আছে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছিল সেই আশির দশক থেকে। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে পদ্মা সেতু কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এই সেতুর মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯০ কোটি ডলার, যার মধ্যে ১২০ কোটি ডলার জোগান দিত বিশ্বব্যাংক। বাকিটা আসত এডিবি (৬১ দশমিক ৫ কোটি), জাইকা (৪১ দশমিক ৫ কোটি) ও আইডিবি (১৪ কোটি) থেকে। বাংলাদেশের নিজস্ব তহবিল থেকেও এই প্রকল্পের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ (৫৩ কোটি) আসত, যার একটি বড় অংশ ইতিমধ্যে জমি অধিগ্রহণ, মাটি ভরাট প্রভৃতি কাজে খরচ হয়েছে। এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে এ ব্যাপারে সবার আগে আগ্রহ দেখায় এডিবি ও জাইকা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্পটিতে বিশ্বের বড় অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসঙ্গে করার মধ্যে বর্তমান সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, যা এখন কেউ তেমন বলে না। এটাও ঠিক, এত বড় একটি প্রকল্প এককভাবে বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশের একার পক্ষে এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। যেটি সম্ভব তা হচ্ছে, অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনে নিজস্ব উৎস থেকে সর্বাধিক অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করা, যেটি বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর ক্ষেত্রে বেশ ভালোভাবেই করেছে। সেই সেতু শুরু হয়েছিল জনগণ থেকে বিভিন্ন ধরনের সারচার্জের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। বাকি অর্থলগ্নিকারী ও দাতা প্রতিষ্ঠান পরে এসেছিল। উন্নয়নশীল ও গরিব দেশগুলো অনেক সময় নিজেরাই আপদ ডেকে আনে, যখন তারা বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের শরণাপন্ন হয়।
১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তাত্ত্বিকভাবে দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হলেও এদের পক্ষে কখনো সম্ভব নয় যুক্তরাষ্ট্রের কথার বাইরে গিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া। অথচ উভয়েরই সদস্যরাষ্ট্রের সংখ্যা ১৮৮। বিশ্বব্যাংকের প্রধান সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আর আইএমএফের প্রধান একজন ইউরোপিয়ান, যদিও তাঁর নিয়োগেও অলিখিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সায় থাকতে হয়। আর এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের ক্ষেত্রেই পশ্চিমা দেশগুলোর ইহুদি (জায়নিস্ট) লবির একটা বড় ভূমিকা থাকে। একটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির একজন সিনিয়র অধ্যাপক যুক্তরাষ্ট্র থেকে সম্প্রতি আমাকে ইন্টারনেটে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। তিনি একসময় বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আঙ্কটাডের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। তিনি লিখেছেন, তাদের সঙ্গে কাজ না করলে বাইরে থেকে বোঝা যাবে না, এসব সংস্থার ভেতরে কত অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়।
বিশ্বব্যাংক কোনো দেশের প্রকল্পে অর্থায়ন করলে প্রকল্প নির্ধারণ থেকে শুরু করে প্রকল্প বাছাই, ঠিকাদার ও পরামর্শক নিয়োগ—সব নিজেদের ইচ্ছামতো করতে চায় এবং তা করতে চাওয়ায় নিজেদের স্বার্থকেই সব সময় প্রাধান্য দেয়, ঋণগ্রহীতা দেশের স্বার্থ তখন গৌণ হয়ে পড়ে। যেহেতু আমি নিজে এমন একটা বড় প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, সেহেতু এই মন্তব্য অভিজ্ঞতাপ্রসূত। এককথায়, বিশ্বব্যাংক সুযোগ পেলে সব দেশেই দাদাগিরি করতে কুণ্ঠিত হয় না। এমন একটি মন্তব্য সম্প্রতি টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান করেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে হয়।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ শুধু একটি মন্তব্যের জন্য তাঁর পদ থেকে অপসারিত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, যেসব দেশ বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করেছে বা তাদের পরামর্শে বেশি কান দিয়েছে, সেসব দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে, সরকারের পতন হয়েছে এবং রাজপথে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে। তিনি বিশ্বব্যাংক ছাড়ার আগে সঙ্গে করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্রের কপি নিয়ে যান। সেসব দলিলপত্রে অনেক দেশের কথা উল্লেখ আছে, যেগুলো বিশ্বব্যাংকের পরামর্শের কারণে প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি আর্জেন্টিনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, আশির দশকের শেষের দিক থেকে শুরু করে উল্লিখিত দুটি সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী সে দেশের সরকার জনসেবামূলক (যেমন, পানীয় জল সরবরাহ) বেসরকারীকরণসহ বিভিন্ন খাত থেকে ভর্তুকি কমানো শুরু করে, জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়াতে থাকে এবং অবশেষে দেশটিতে শুরু হয় চরম রাজনৈতিক অসন্তোষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা। সে দেশে এ সময় পাঁচ সপ্তাহে ছয়জন রাষ্ট্রপতি পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। স্টিগলিজ আরও লিখেছেন, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করার জন্য সে দেশের অনেক রাজনীতিবিদকে ভারী রকমের উৎকোচ প্রদান করে। যেসব দেশের সরকার দুর্বল, সেসব দেশ অনেক সময় বাধ্য হয় বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের নানা গণবিরোধী পরামর্শ মেনে নিতে। যাদের মেরুদণ্ড শক্ত, তারা এসব অযাচিত পরামর্শের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারে। ১৯৭৬ সালে বিশ্বব্যাংক ভারতের সুবর্ণরেখা (বিহার-ওডিশা) নদীতে একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে অর্থায়ন করেছিল। প্রকল্পের মাঝপথে তারা সরকারকে নতুন নতুন শর্ত দেওয়া শুরু করে। এতে বিরক্ত হয়ে ভারত সরকার বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দেয়। সরকারের এই সিদ্ধান্ত সে দেশের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দল একযোগে সমর্থন করে। সব স্বার্থের আগে দেশের স্বার্থ। পরে বিশ্বব্যাংক নিজ গরজেই অর্থায়নে ফিরে আসে। আসলে বিশ্বব্যাংক হচ্ছে একটি বড় মহাজন। টাকা ধার দেওয়াই তাদের কাজ-কারবার। ২০০৪-০৫ সালে বিশ্বের অন্যতম তেলসমৃদ্ধ দেশ ভেনেজুয়েলা দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের অতিরিক্ত পরামর্শ শুনে। এরপর সে দেশের প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজ এ দুটি সংস্থা থেকে নিজ দেশকে প্রত্যাহার করে নেন। চীন একটি বড় দাতাদেশ হয়েও বিশ্বব্যাংক থেকে অর্থ ধার করে, তবে তাদের শর্তে। বাংলাদেশের পক্ষে এমন শক্ত অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়, নিলে যদি বিশ্বব্যাংকের তা পছন্দ না হয় এবং তারা কোনো প্রকল্পের অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় (যেমন, পদ্মা সেতু), তখন সবকিছুর আগে বিরোধী দলগুলো বুঝে হোক আর না বুঝে হোক ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ দাবি করবে আর সরকারের দিকে সবাই তির ছুড়বে।
সামান্য আলোচনা করতে চাই পদ্মা সেতুর বিষয়ে। শ্রদ্ধেয় ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী পদ্মা সেতু প্রকল্প-বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২ জুলাইসমকাল-এ তাঁর একটি চমৎকার বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সেখানে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, বিশ্বব্যাংক কীভাবে একটি ভুয়া চীনা কোম্পানিকে (সিআরসিসি) প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও পরামর্শক হিসেবে এই প্রকল্পে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে এবং সেই কোম্পানি কেমন সব জালিয়াতি করেছে। সেই কোম্পানিকে গেলাতে ব্যর্থ হয়ে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ওপর বেশ ক্ষুব্ধ হয় এবং পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিলে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে বিশ্বাস। দুর্নীতির অভিযোগটা হয়তো একটি অজুহাত। বাকি বিষয়গুলো সম্পর্কে বলা থেকে বিরত থাকলাম। কারণ, এসব বিষয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। তবে সরকারের এখন যা করা উচিত, বিশ্বব্যাংক সরকারকে যেসব চিঠিপত্র লিখেছে, তা উন্মুক্ত করে দেওয়া এবং যে অভিযোগ নিয়ে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে অপমান করেছে, তার একটি সুষ্ঠু (বিচার বিভাগীয় বা সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে) তদন্ত করা। আর পদ্মার ওপর সেতু হবে, এটি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদা ছিল। যদি সেই ওয়াদা শেষ পর্যন্ত পূরণ না করা যায়, তাও সব তথ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকেই জাতির সামনে তুলে ধরা উচিত। কারণ, তাঁকে এখনো মানুষ বিশ্বাস করে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম দেশ। দেশের স্বার্থে বিশ্বব্যাংকের সব দাবি পূরণ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। আবার এটাও ঠিক, জাতীয় স্বার্থে কোনো ব্যক্তিকেই অপরিহার্য ভাবা উচিত নয়। 
সব শেষে একটি তত্ত্ব দিয়ে লেখাটি শেষ করি। এই পদ্মা সেতু বিষয়টি পুঁজি করে সামনের নির্বাচনে বিরোধী দল বিজয়ী হতে চাইবে। তাদের পিঠে চড়ে আবার জঙ্গিবাদের রমরমা উত্থান হবে। সেই সুযোগ পশ্চিমা দুনিয়া বাংলাদেশে ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ রপ্তানি করতে উদ্যোগী হবে। আসলে সবকিছুই মনে হয় পূর্বপরিকল্পিত।
 আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শনিবার, ২৩ জুন, ২০১২

রোহিঙ্গাদের নিয়ে সস্তা রাজনীতি না করা ভাল

আবদুল মান্নান


আমাদের একেবারে বাড়ির পাশে বর্মা মুলুকে অনেককাল ধরে সরকারীভাবে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে জাতিগত দাঙ্গার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার অভিযান চলছে এবং তা দেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একেবারে চুপ। বর্মা মুলুকের বর্তমান নাম মিয়ানমার। দেশটি প্রায় অর্ধশতক ধরে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। সম্প্রতি সে দেশে আবার গণতান্ত্রিক ধারা ফিরতে শুরু করেছে বলে বিশ্ব সম্প্রদায় মনে করে। তাদের ধারণা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্যাতনের বিষয়ে বেশি চাপাচাপি করলে সে দেশে আবার গণতন্ত্র হুমকির সামনে পড়তে পারে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ মুক্ত মানুষ হিসেবে বাস করতে পারা উচিত। তা যদি না-ই হবে তাহলে সে দেশকে কোনভাবেই গণতান্ত্রিক দেশ বলা যাবে না। অবশ্য পশ্চিমা বিশ্বের একেকটি দেশের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা আবার একেক রকম। যে মানুষগুলো সে দেশে নির্যাতিত হচ্ছে তারা জাতে রোহিঙ্গা, ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান। বেশিরভাগেরই আবাস উত্তর আরাকান প্রদেশে। তারা সেখানে কিভাবে এলো তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। কোন কোন ইতিহাসবিদ মনে করেন, রোহিঙ্গারা আরব দেশ থেকে এসে সেখানে বসতি গেঁড়েছিল সেই অষ্টম শতকে। কারও কারও মতে, তারা ভারতবর্ষের গুজরাট অঞ্চল ও আফগানিস্তান হতে সেখানে হিযরত করে চাষবাস শুরু করেছিল। এলাকাটি চট্টগ্রামের সংলগ্ন হওয়াতে তাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের মানুষের উঠবস বেশি ছিল। তাদের ভাষার সঙ্গে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার বেশ মিল আছে। যেখান থেকেই তারা আসুক না কেন তারা এখন মিয়ানমারের অধিবাসী। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে পরবর্র্তীকালের মিয়ানমারের কোন সরকারই তা স্বীকার করেনি এবং যুগ যুগ ধরে তারা নির্যাতিত হয়েছে। বর্মার সরকার সব সময় মনে করে, বর্মায় একেবারে স্থানীয় ও বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ছাড়া সকলেই বহিরাগত। ভারতীয় হলে তো কথাই নেই। বর্তমানে সে দেশে প্রায় ত্রিশ লাখ ভারতীয় বংশদ্ভূত মানুষ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বাস করে। চীনা ও মালয়ের মুসলমানদের অবস্থাও একই রকম। তবে তাদের সংখ্যা রোহিঙ্গাদের চাইতে কম। কথায় কথায় সকলে নির্যাতন এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়। সে দেশে ১৩৫টি আদিবাসীকে সরকারীভাবে নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী বলে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। বাদ পড়েছে শুধু রোহিঙ্গারা। তাদের অপরাধ তারা ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান এবং গায়ের রং কালো। 
এবার আমার বাবার কথা বলি। ত্রিশের দশকে তাঁর যৌবনকাল। ভাগ্য ফেরাতে ছুটলেন বর্মা মুলুকে। তখন অবিভক্ত বাংলার তো বটেই ভারতবর্ষের মানুষ ভাগ্যান্বেষণে ছুটতেন রেঙ্গুন না হয় আকিয়াবে। এই অঞ্চলের একমাত্র সমৃদ্ধশালী দেশ তখন বর্মা। চট্টগ্রামের মানুষ সমুদ্রপথে এক সকালে যাত্রা করে পরদিন আকিয়াব পৌঁছে যেত, কয়েকদিন পর রেঙ্গুন বন্দরে। সে দেশে বিয়েশাদীও করেছেন অনেকে। বাবা ছোটখাটো একটা রেস্টুরেন্ট খুলে বসেছিলেন। তবে তাঁর দোকানের বেশিরভাগ খদ্দের ভারতীয়। কদাচ কোন স্থানীয় মানুষ দোকানে প্রবেশ করত। বাবা-চাচাদের কাছে শুনেছি, বার্মিজ মেয়েদের কাছে ভারতীয় পুরুষদের কদর ছিল বেশ। তাদের বিয়ে করার এক ধরনের আকুতিও নাকি ছিল । অবশ্য তিনি সে খপ্পরে পড়েননি। আয় রোজগার ভাল। ব্যাচেলর মানুষ। কিছু টাকা জমিয়ে একটা গাড়িও নাকি কিনেছিলেন। ট্যাক্সি হিসেবে চলত। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। জাপানীদের হাতে সিঙ্গাপুর পতনের পর ১৯৪২ সালে বর্মার পতন হলো। বাবা বলতেন বার্মিজরা সম্ভবত এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিল। প্রথম সুযোগেই জাপানী সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে শুরু করে দিল ভয়াবহ দাঙ্গা। এটি ছিল ভারতীয়দের বর্মা থেকে উৎখাত করার দাঙ্গা। বাবা হাজার হাজার ভারতীয়ের সঙ্গে এককাপড়ে হেঁটে রওনা দিলেন দেশের উদ্দেশ্যে। প্রায় একমাস চলার পর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় চট্টগ্রাম পৌঁছেছিলেন। পথে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
বর্মায় বর্ণ এবং জাতিবিদ্বেষ এখনও প্রকটভাবে বিদ্যমান। অথচ এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্পূর্ণ নীরব। বর্মায় বসবাসরত নাগরিকদের দু’ধরনের পরিচয়পত্র দেয়া হয়। একটি লাল রং-এর অন্যটি সাদা। লালটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বার্মিজদের। অন্যটি সাদা, পেছনে লেখা থাকে এই কার্ডধারী বর্মার নাগরিক নয়। রোহিঙ্গাদের কার্ডের পেছনে লেখা থাকে; এর বাহক একজন বাঙালী মুসলমান। এটি একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার যে একবিংশ শতকে এসেও নাৎসি জার্মানির একটি মডেল রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নিয়েছে এবং ইদানীং সকলে মিয়ানমারের নতুন সরকারকে হাত কচলে বেশ খোশামোদ করছে। 
উত্তর আরাকান প্রদেশ বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা। এখানকার রোহিঙ্গারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের হাতেই সর্বাধিক নিগৃহীত হয়। এদের বিয়ে করতে হলে প্রশাসন থেকে পূর্বানুমতি নিতে হয়, যা সচরাচর মিলে না। বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না। রোহিঙ্গাদের এখান হতে অন্য প্রদেশে যাওয়া বেআইনী। মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশ বাহিনীতে কোন রোহিঙ্গা মুসলমানের চাকরি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। স্থানীয় রাখাইনরা সুযোগ পেলেই দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু করে। এসবের কোন বিচার কখনও হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরাকান রাজ্যে প্রথম বড় ধরনের দাঙ্গা হয় ১৯৬২ সালে। তখন কয়েক হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু কক্সবাজার হয়ে চট্টগ্রাম প্রবেশ করে। কয়েক হাজার থাইল্যান্ডেও চলে যায়। সে সময় যারা চট্টগ্রামে এসেছিল পরবর্তীকালে তারা এখানকার মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। 
স্বাধীন বাংলাদেশে ভিটামাটি হতে উচ্ছেদ হয়ে রোহিঙ্গাদের প্রথম অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৭৮ এবং ১৯৭৯ সালে যখন আরাকানে বর্মার সেনাবাহিনী অপারেশন ‘নাগামিন’ নামে একটি জাতিগত শুদ্ধি অভিযান শুরু করে। সে ধাক্কায় বাংলাদেশে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সমস্যাটির কোন কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা না করে নাফ নদীতে নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ পাঠায়। সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। পাল্টা বর্মাও একই কাজ করে। কিন্তু সমস্যা সমস্যাই থেকে যায়। আরেকটি ধাক্কা আসে ১৯৯০-৯১ সালে যখন প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার এমন অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ করার জন্য একটি দেশও বাংলাদেশের পাশে কার্যকরভাবে দাঁড়ায়নি। শুধু জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা কিছু রিলিফসামগ্রী নিয়ে কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া, কুতুপালং প্রভৃতি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে তাদের পাশে দাঁড়ায় তবে তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বর্তমানে সরকারীভাবে দু’টি শরণার্থী শিবির আছে। বাংলাদেশ মাঝে মাঝে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সে দেশে ফেরত পাঠাতে কয়েকবার চেষ্টা করেও তেমন একটা সফল হয়নি। তারা শুধু কয়েক হাজার শরণার্থীকে ফিরিয়ে নিয়ে সাফ জানিয়ে দেয়Ñ বাকিরা তাদের দেশের নাগরিক নয়। বাংলাদেশের মতো একটা দেশের পক্ষে সম্ভব নয় কয়েক লাখ শরণার্থীকে বছরের পর বছর চারদিকে তারকাঁটার বেড়া দিয়ে আটক করে রাখা। বর্তমানে দুই ক্যাম্পে শুধু ত্রিশ হাজারের মতো তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা আছে বাকিরা দেশের জনারণ্যে মিশে গেছে এবং বিভিন্ন সময় তারা একশ্রেণীর দালাল আর অসাধু সরকারী কর্মকর্তাদের সহায়তায় বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে শুধু চলেই যায়নি সেসব দেশে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের সুনামের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে তাদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশে মাদক ব্যবসা এবং নারী ও শিশু পাচারসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে কয়েক শ’ রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম শহরে চলে এসেছে। চট্টগ্রাম এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের চারপাশের সকল খালি জায়গা ইতোমধ্যে তাদের দখলে চলে গেছে। এলাকাটি হয়ে পড়েছে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। তবে সব চাইতে যেটি ভয়াবহ সমস্যা এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো এখন জঙ্গী তৈরির প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এদের নিয়ে গোপনে কাজ করে সৌদি আরবভিত্তিক রাবিতাত আল ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, হেফাজতে ইসলামসহ অনেক ধর্মান্ধ মৌলবাদী দল ও জঙ্গীবাদী সংগঠন। 
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সবচাইতে হতাশাজনক ভূমিকা পালন করেছে গণতন্ত্রের মানসকন্যা খ্যাত আউন সান সুচি। এ ব্যাপারে তার কোন কার্যকর ভূমিকা চোখে পড়ে না। সম্প্রতি তিনি অসলোতে একুশ বছর পূর্বে তাকে প্রদত্ত শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার নিতে গিয়ে তাঁর বক্তৃতায় বলেনÑপ্রবাসী বার্মিজরা মিয়ানমারে সকল নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মাঝে শান্তি ফিরিয়ে আনতে গুরুপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যস, ওটুকুই । 
সম্প্রতি নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রবেশকে কেন্দ্র করে নানা বিতর্কের জন্ম হয়েছে। সরকার নতুন করে কোন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দিতে নারাজ। সার্বিক বিচারে এটি সরকারের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে অনেকে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, সরকারের উচিত আরও একটু মানবিক হওয়া। এই প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট কয়েক ব্যক্তি ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েছেন। জামায়াত-বিএনপি বলেছে, সরকারের উচিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া। একজন সিনিয়র সাংবাদিক কলাম লিখে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের যেন আবার বাঘের মুখে ঠেলে দেয়া না হয়। সরকারী দলের এক সংসদ সদস্য পত্রিকায় মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে বলেছেনÑরোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখে তার রাতে ঘুম হয় না। জাতিসংঘ আর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে। জামায়াত আর বিএনপির বলার মধ্যে একটা বড় বদমতলব আছে। বিএনপি আমলে এই রোহিঙ্গাদের অনেকেই ভোটার হয়েছে। সে ভোট তাদের বাক্সে পড়বে। তাদের আমলেই সবচাইতে বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গেছে। জামায়াত ও সমমনা দল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এদেরকে তাদের জিহাদী আর সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করবে। এদের প্রতি আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায়ের জন্য এরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কার বিখ্যাত মাইলাই গণহত্যার একটি ছবি তারা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ছবি বলে ইন্টারনেটে আপলোড করেছে। অন্য আর একটি ছবি আছে যেটি আসলে থাই পুলিশের হাতে ধৃত গোটাপঞ্চাশেক রোহিঙ্গার। পুলিশ তাদের সমুদ্রের বালিতে উপুড় করে শুয়ে রেখেছে। কিন্তু ছবির ক্যাপসান দেয়া আছে বর্মার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মেরে ফেলে রেখেছে। টেকনাফে এখন কিছু মোবাইল ফোনের দোকানে কিছু হিন্দী ছবির নির্যাতনের দৃশ্যের ক্লিপিং পাওয়া যায় যা রোহিঙ্গা নির্যাতনের ছবি হিসেবে মোবাইলে ডাউনলোড করে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এটি সত্য, সাম্প্রতিক দাঙ্গায় অনেক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে, অনেক নারী ধর্ষিত হয়েছে। তবে এই ছবিগুলোর কোনটাই সে সবের নয়। টেকনাফ আর কক্সবাজারে জামায়াতের নেটওয়ার্ক বেশ শক্তিশালী। শোনা যায়, অনেক রোহিঙ্গা গোপনে জামায়াতীদের বাড়িতেও আশ্রয় নিয়েছে। পুরো এলাকা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার দাবি সংবলিত পোস্টারে ছেয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা এখানে নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব এলাকার দিনমজুরদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ দানা বাঁধছে। কারণ যেখানে একজন দিনমজুরের দৈনিক পারিশ্রমিক দেড় থেকে দুই শ’ টাকা সেখানে একজন রোহিঙ্গা শ্রমিক পাওয়া যায় পঞ্চাশ টাকা দিয়ে। যাঁরা মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে বলেন তাঁরা এখানকার বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত নন। বাংলাদেশ অতীতে সব সময় মানবিক আচরণ করেছে, এখনও করছে। কিন্তু তাতে ফলাফল শূন্য। এ সম্পর্কে আমাদের বিশিষ্টজনরা একেবারেই নিশ্চুপ। 
কেউ কেউ অনেকটা অর্বাচীনের মতো রোহিঙ্গাদের সমস্যাকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেন। একাত্তর সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করছিলাম। সেই যুদ্ধে এক কোটি বাঙালী শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমরা একটা প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলাম। শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তারা যাতে নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যায় সে চেষ্টা করেছিল ভারত। যুদ্ধ শেষে দ্রুততম সময়ে প্রত্যেক বাংলাদেশী নিজ দেশে ফিরে এসেছিলেন। ভারতে থেকে গিয়েছে তেমন বাঙালী হাতে গোনা যায়। একাত্তরের বাংলাদেশের শরণার্থীদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের তুলনা করা চরম মূর্খতার শামিল। 
এটি ঠিক মিয়ানমার বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। তাদের সঙ্গে আমাদের অনেক অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। তবুও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ চুপ থাকতে পারে না। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহল থেকে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য সকল ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। প্রয়োজনে বিষয়টা জাতিসংঘের নজরে আনতে হবে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা ভারত তেমন কিছু করবে বলে মনে হয় না। কারণ নতুন মিয়ানমারের অফুরন্ত সম্পদ ও সম্ভাবনার দিকে এখন তাদের সকলের লোলুপ দৃষ্টি। সকলে নিজের স্বার্থ রক্ষাকে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দেয়। কিছুদিনের মধ্যে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে। বাংলাদেশকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করার বিষয়ে নিশ্চয় আলাপ হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার মতো একটি সমস্যা জিইয়ে রেখে কোন সম্পর্কই যে কার্যকর হবে না তা তাকে বুঝতে দিতে হবে। বাংলাদেশ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সমস্যার মীমাংসা করেছে। এই সমস্যারও সমাধান হবে, তা মানুষ আশা করতেই পারে। এটি যত না গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য তার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মিয়ানমারের জন্য। এর ব্যত্যয় ঘটলে একটি নতুন গণতান্ত্রিক মিয়ানমারের অভ্যুদয় অধরাই থেকে যাবে।
বিএনপি-জামায়াতের কথা বাদ দিলাম। বাকি যাঁরা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে ওকালতি করছেন তাঁদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছিÑবাস্তবতাটা উপলব্ধি করুন, নিজের দেশের স্বার্থটাকে সবার ওপর স্থান দিন। এখনও বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণ রোহিঙ্গাদের প্রতি অনেক মানবিক আচরণ করছে। 

লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক। জুন ২২, ২০১২

নতুন ইতিহাস নির্মাণ করা সম্ভব


আবদুল মান্নান 

২০১৪ সালে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের দুটি বড় দল ইতিমধ্যে হিসাব-নিকাশ শুরু করে দিয়েছে। এটি ভালো লক্ষণ। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই নির্বাচন তাঁর সরকারের বর্তমান মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই অনুষ্ঠিত হবে। সংসদে প্রধান বিরোধী দল দুই বছর ধরে মধ্যবর্তী নির্বাচন দাবি করে আসছে। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। বিরোধী দলে গিয়ে নিজের নেতা-কর্মীদের মনোবল চাঙা রাখার জন্য ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে এমন দাবি তোলা নতুন কিছু নয়। তবে বাস্তবে ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ছাড়া সব সরকারই তাদের পূর্ণ মেয়াদ শেষ করেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা তাঁর দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৭৫টি আসনের অবস্থা ভালো, ৩০টির অবস্থা মাঝামাঝি আর ৩০টির অবস্থা খুব খারাপ। বিএনপি মনে করে, তাদের দাবি অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ নামক দলটির অস্তিত্ব তেমন থাকবে না, তারা বড়জোর ১০-২০টি আসনে বিজয়ী হতে পারে। তারা মনে করে, ভোটাররা তাদের আগের শাসনামলের সব অপকর্মের কথা ইতিমধ্যে ভুলে গেছেন। তবে তাদের ধারণা তেমন অমূলক তা বলা যাবে না। কারণ, বাঙালি খুব বিস্মৃতিপরায়ণ। 
শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে। যেদিন তিনি তাঁর এই বক্তব্য দিলেন, সেদিন রাতের এক টক শোতে একজন সিনিয়র সাংবাদিক বলেন, ১৭৫ আসন অর্ধেক হতে বেশি সময় লাগবে না। অনুজপ্রতিম সাংবাদিক সোহরাব হাসান প্রথম আলোয় উপসম্পাদকীয়তে ঐকিক নিয়মে অঙ্ক কষে বলার চেষ্টা করলেন, ২৩৩ আসন থেকে ১৭৫ আসনে নামতে যদি সাড়ে তিন বছর সময় লাগে, তাহলে বাকি দেড় বছরে তা কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে, তা হিসাব করতে হবে। সম্ভাব্য পরিণতি হিসেবে কার্টুন দিয়ে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করলেন ১৭৫-এর ১ ব্যর্থতার ভারে আবর্জনার ঝুড়িতে পড়ে যেতে পারে। বন্ধু মুনতাসীর মামুন সুদূর নিউইয়র্ক থেকে ঘোষণা করে সবাইকে জানিয়ে দিলেন আওয়ামী লীগের অবস্থা শহরে তেমন ভালো না হলেও গ্রামে ভালো। কারণ, শেখ হাসিনা গ্রামের মানুষের পেটে ভাত দিয়েছেন। 
একটু পেছনে ফিরে গিয়ে দুটো ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান সম্পূর্ণ নির্বাচন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিচ্ছেন, তখন সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে আমি একটি দৈনিকে সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে একটি উপসম্পাদকীয় পাঠিয়েছিলাম। অবশ্য সেটি তখন প্রকাশিত হয়নি। সম্ভবত পত্রিকাটি জনমনে হতাশা প্রচার করতে চায়নি। তবে একই সন্দেহ প্রকাশ করে অন্য দুটি জাতীয় দৈনিকে উপসম্পাদকীয় লিখেছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক এবিএম মূসা ও আবেদ খান। নির্বাচনের পর তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হওয়ায় অনেকে অবাক হয়েছিলেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই। জনগণের কাতারে থেকে জনগণের মতি-গতি বোঝা খুব কঠিন নয়। শাসক জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমলা, স্তাবক, তোষামোদকারী আর গোয়েন্দানির্ভর হয়ে পড়লে বিপদ হতে পারে। দ্বিতীয় ঘটনা ২০১০ সালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়ের। তখনো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়নি। এটি মোটামুটি নিশ্চিত, নাগরিক কমিটির ব্যানারে তৎকালীন মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় চার দশকের। আমাকে পরিবারের একজনের মতো স্নেহ করেন। তাঁর প্রতিটা নির্বাচনের সময় সাধ্যমতো তাঁর জন্য পরিশ্রম করেছি। এবার বুঝতে পারছিলাম পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে নয়। তিনবারের নির্বাচিত মেয়র অনেক পুরোনো বন্ধু ও সুহূদ হারিয়েছেন। কাছে টানতে পারেননি নতুন কাউকে। কিছু স্তাবক আর চাটুকার তাঁর চারপাশে একটি দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করে রেখেছিল। সময় চেয়ে নিয়ে আসন্ন নির্বাচন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে এক সকালে তাঁর বাসায় হাজির হলাম। দুজনের মধ্যে অনেকটা ক্লোজডোর মিটিং। তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম সামনের নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে আনা সহজ হবে না। যদি ছিনিয়েই আনতে হয়, তাহলে তাঁকে ঘর গোছাতে হবে এবং দূরে সরে যাওয়া মানুষদের কাছে টানতে হবে, চাটুকারমুক্ত হতে হবে। তিনি ধৈর্য সহকারে শুনলেন। কাজ হলো না কিছু। পরের ঘটনা সবাই জানে। প্রায় এক লাখ ভোটে পরাজিত হলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁঁরই একজন ওয়ার্ড কমিশনারের কাছে।
এবার দেখা যাক আসন্ন সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৭৫ আসনের ভবিষ্যদ্বাণীর কী হতে পারে। আমার আলোচনায় কেউ সহমত পোষণ করবেন তা মনে করি না। তবে বলে নেওয়া ভালো, বাংলাদেশে যারা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে স্বস্তি বোধ করে, তার মধ্যে আমিও একজন। এই স্বস্তিবোধটা এই কারণে নয় যে দলটি ক্ষমতায় এলে ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো কিছু প্রত্যাশা করি। স্বস্তিবোধ এই কারণেই, দলটি বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত দল। এই দলের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও এখনো মনে করা হয়, এই দলটি প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতীক। এই দল বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলে। ইদানীং দলে অনেক সুবিধাবাদীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে সত্য কিন্তু এই দলে এখনো তৃণমূল পর্যায়ে লাখ লাখ নেতা-কর্মী আছেন, যাঁরা দলটির জন্য নিজের জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত। ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের পর পালা করে বিএনপি-জামায়াত জোট আর আওয়ামী লীগ চার মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে। কোনো দল পর পর দুবার ক্ষমতায় ছিল না। সে হিসাবে সামনের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার কথা। তেমনটি হবে বলে অনেকে মনেও করেন। তবে সব সময় তা না-ও হতে পারে, যদি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাকি সময়টা কার্যকরভাবে দল গোছাতে এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণে আরও মনোযোগী হয়।
এটা স্বীকার করতেই হবে অন্য যে কোনো দলের চেয়ে আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের চাহিদা এবং প্রত্যাশা অনেক গুণ বেশি। মানুষ মনে করে যে দলটি বাঙালিকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিতে পারে, সে দল দেশের মঙ্গলের জন্য সবকিছুই করতে পারে। অন্য দলগুলো তো অনেকটা সুবিধাভোগীদের ক্লাবের মতো। বঙ্গবন্ধুর জীবনটাই ছিল ত্যাগে ভরপুর। সুতরাং তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের আচার-আচরণেও তা থাকা উচিত। তারা বঙ্গবন্ধুর ওই শূন্যস্থানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে দেখতে চায়। কিন্তু বাস্তবে বঙ্গবন্ধুর ওই স্থান পূরণ করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তার পরও তারা শেখ হাসিনার ওপর তাদের আস্থা রাখতে চায়। কিন্তু অনেক সময় তাঁর চারপাশে থাকা কিছু ব্যক্তি, স্তাবক, কিছু মন্ত্রী এবং কিছু নেতা-নেত্রীর অপরিণামদর্শী কার্যকলাপের কারণে মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ অঙ্গীকার করেছিল, নির্বাচনে বিজয়ী হলে পদ্মা সেতু হবে। সেটা হয়নি। তাই বলে কি এই পদ্মা সেতু না হওয়াটা আগামী নির্বাচনে কোনো ভূমিকা রাখবে? হয়তো রাখবে, তবে তার চেয়েও বেশি রাখবে দলটিকে ঘিরে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, সে অভিযোগ। সাধারণ মানুষ বুঝতে অক্ষম, যাঁদের বিরুদ্ধে এত বড় দুর্নীতির অভিযোগ আছে, মন্ত্রিসভা থেকে তাঁদের ছেঁটে ফেললে দল বা সরকারের কী ক্ষতি? মন্ত্রিসভায় ডজন খানেক মন্ত্রী আছেন, যাঁরা না থাকলে দল বা সরকারের কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। সরকারের সাড়ে তিন বছরে তাঁদের দৃশ্যমান কোনো অর্জন চোখে পড়ে না। মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করে তাঁদের বাদ দিয়ে কাজের লোক মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করলে বাদ যাওয়াদের ব্যক্তিগত ক্ষতি হতে পারে। তবে দল ও জাতি লাভবান হবে। 
যেসব জিনিস মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে স্পর্শ করে, তার মধ্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারমূল্য ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে শহুরে মানুষের কাছে। আবার শহুরে মানুষেরা বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে তাদের মতামত ব্যক্ত করে গ্রামের মানুষকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। আগামী দেড় বছরে দ্রুততম সময়ে এসব সমস্যার উন্নতি ঘটাতে হবে। মানুষ কোনো অজুহাত শুনতে নারাজ। তারা বলে অজুহাত না শোনার জন্যই তো আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছি। তা না হলে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যে দুঃশাসন চলছিল, তা তেমন আর খারাপ কী ছিল? বর্তমান অবস্থা বিচার করলে এটি সবার কাছে মনে হবে, বাংলাদেশে যেসব ব্যবসায়ী নিত্যপণ্যের আমদানি বা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাঁরা প্রত্যেকে অসাধু এবং প্রত্যেকে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ব্যবসা করেন। তাঁদের খপ্পর থেকে মানুষকে বের করে আনা সরকারের দায়িত্ব। এতে হয়তো সরকারি দলের কিছু মাথা যাবে। তাতে ক্ষতি কী? এঁদের কারণেই তো আগামীবার আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা কঠিন হবে। 
৩০ বা ৬০ নয়, কম-বেশি ১০০ আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করতে হবে। পিস্তলওয়ালা আর সরকারি কর্মকর্তাদের চড়-থাপ্পড় মারা সাংসদদের কোনো প্রয়োজন আওয়ামী লীগের থাকতে পারে না। যুবলীগ আর ছাত্রলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্তের দৌরাত্ম্য দমন করতে না পারলে বিপদ হতে পারে। সরকার কিছু অপরিণামদর্শী উপদেষ্টা আর অসাধু আমলার খপ্পরে পড়েছে। তাঁদের কাছ থেকে সরকারকে উদ্ধার করা কি খুব কঠিন? কোনো কিছুই কঠিন নয়। শুধু বঙ্গবন্ধুকন্যার একটু সাহসের প্রয়োজন আছে। তা তাঁর আছে বলে বিশ্বাস। এই সাহস শুধু কাজে লাগাতে হবে। গত নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সরকারের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। দলটিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। তা যদি তিনি করতে পারেন, তাহলে সামনের নির্বাচনে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে নতুন ইতিহাস নির্মাণ করা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী দেখবেন নাকি একটু চেষ্টা করে? গোয়েন্দা সংস্থা আপনি যা শুনলে খুশি হবেন তা-ই বলবে। সব সময় সত্য কথা নয়। আওয়ামী লীগের ৬৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দলের সব ত্যাগী নেতা-কর্মীদের অভিনন্দন।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

রবিবার, ১৭ জুন, ২০১২

একটি গণঅভ্যুত্থানের সন্ধানে

আবদুল মান্নান


বছর দুই ধরে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী দল সরকারবিরোধী আন্দোলনে করে আসছে। প্রথমে তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটকে নিয়ে। আন্দোলনে চাঙ্গা করতে তেমন সুবিধা করতে না পারায় পরে তাতে আরও কিছু নামসর্বস্ব ওয়ানম্যান হোন্ডা পার্টি যোগ হয়। এখন এই বিরোধীদলীয় মোর্চাকে বল হয় ১৮ দলীয় জাতীয়তাবাদী ঐক্যজোট। তাদের সকলের নেতা বেগম জিয়া। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সরকার বিরোধী দল বা জোট থাকবে তাই স্বাভাবিক। এই বিরোধী দল বা জোট সংসদ এবং সংসদের বাইরে সরকারের বিভিন্ন নীতি, কার্যক্রম, ব্যর্থতা এবং সিদ্ধান্তের সমালোচনা করবে এবং সরকারকে ভাল বিকল্প দেখাবে আর সরকারও তা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করবে এটাই রীতি হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তেমনটি ঘটতে অতীতে কখনও দেখা যায়নি। আগামীতেও দেখা যাওয়ার তেমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের দুটি বড় দলের প্রধান শেখ হাসিনা ও বেগম জিয়ার কিছু রাজনৈতিক এবং আচরণগত বৈপরীত্য লক্ষণীয়। বেগম জিয়া কখনও সাধারণ মানুষের কাতার থেকে রাজনীতি দেখেননি করার কথা দূরে থাক। তিনি ছিলেন এক সামরিক অফিসারের গৃহিণী। বিবাহিত জীবন ব্যাটম্যান সংস্কৃৃতিতে কাটিয়েছেন। ফায়-ফরমায়েশ খাটার জন্য গ-ায় গ-ায় চাকর-বাকর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকত। বন্ধু মুনতাসীর মামুনের ভাষায় ‘কোই হাই সংস্কৃৃতি’ আর কী। হুকুম দিলেই সব কিছু হাতের কাছে পাওয়া যেত। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর খোন্দকার মোশতাকের হাত ঘুরে দেশের শাসন ভার সেনাপ্রধান স্বামী জিয়ার হাতে গেলে তিনি প্রথম রাষ্ট্রক্ষমতা কী তার মজা বুঝেন। আবার জিয়ার মৃত্যু হলে তিনি একসময় দলীয়প্রধান হিসাবে অভিসিক্ত হন তারপর এরশাদ পতনের পর দেশের প্রধানমন্ত্রী। বেগম জিয়ার রাজনীতিতে কখনো ত্যাগ তিতিক্ষা ছিল না। স্বামীর পেশার কারণে তিনি ভোগ বিলাসেই অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে সব কিছু উল্টো। রাজনৈতিক পরিবারের বড় সন্তান। একেবারেই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা। পারিবারিক প্রধান আয়ের সূত্র কৃষি জমি। এক সময় তার পিতা শেখ মুজিব সংসার চালানোর জন্য একটি বীমা কোম্পানিতেও স্বল্প বেতনে চাকরি করেছেন। রাজনীতি করার সূত্রে কারাগারই ছিল তাঁর দ্বিতীয় আবাস। তিনি কারাগারে থাকতেই কন্যা শেখ হাসিনার বিয়ে হয়। বিয়ের খরচ মেটাতে স্ত্রী বেগম মুজিবকে নিকটজনদের কাছ হতে অর্থও ধার করতে হয়। বিয়ের পর নতুন বর কনেকে কিছু আওয়ামী লীগ নেতার উদ্যোগে বিবাহোত্তর সংবর্ধনা দেয়া হয় চট্টগ্রামে। শেখ হাসিনা ছাত্র জীবন হতেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। রাজনীতিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। বাবার সূত্রে অনেক বড় রাজনৈতিক নেতৃবৃৃন্দের সংস্পর্শে এসেছেন। সুতরাং এই দুই নেত্রীর মানসিক গঠন ও রাজনীতি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পৃথক হওয়াটা স্বাভাবিক। যাঁরা দু’জনকে কাছ থেকে দেখেছেন তাদের অনেকের মন্তব্য বেগম জিয়া এটা মেনে নিতে পারেন না তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন আর শেখ হাসিনা অনেক সময় ভুলে যান তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা যখন একান্ত পরিচিত জনের মাঝে থাকেন তখন তিনি হয়ে ওঠেন বাড়ির একজন আপা, বড়বু, খালা, ফুফু অথবা চাচি। বড়দের কাছে তিনি কন্যাসম। গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে ‘মজিবরের মাইয়া।’ তিনি সহজে দূরের মানুষকেও আপন করে নিতে পারেন। বেগম জিয়ার আচার আচরণে এক ধরনের দাম্ভিকতা আছে। তার দলের অনেক বড়মাপের নেতা নেত্রীকে ব্যক্তিগত আলাপে বলতে শুনেছি ম্যাডামের সামনে গেলে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা যায় না। তিনি মাঝখানে এক অদৃশ্য প্রাচীর সৃষ্টি করে ফেলেন। দু’জনের এই যখন অবস্থান তখন বেগম জিয়া তো চাইবেনই তাঁর হারানো অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে। 
এরশাদের পতনের পর কখনও কেউ ভাবেনি ১৯৯১-এর নির্বাচনে বেগম জিয়ার দল বিজয়ী হবে। তিন শ’ সিটে প্রার্থী দেয়ার মতো লোকও তাদের ছিল না। আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক কৌশলগত ভুলে সেই নির্বাচনে তাদের অপ্রত্যাশিত পরাজয়। বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী হয়ে শুধু যে ক্ষমতার স্বাদ পেলেন তাই নয় একই সঙ্গে ফিরে পেলেন তার পুরনো সব ভোগ বিলাসের সুযোগ সুবিধা। এটাই অনেকটা তার মাথা বিগড়ে দিল। এমন সুযোগ-সুবিধা কে ছাড়তে চায়? তারপরও বলতে হয় বেগম জিয়া ১৯৯১-৯৬ সালের শাসনকালে কিছুটা হলেও সংযমী ছিলেন। ২০০১-৬ মেয়াদে তাঁর শাসনামলে যে ধরনের অপশাসন, দুঃশাসন, দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের জন্ম এবং সামরিক বেসামরিক প্রশাসনে এই ভবনের অযাচিত হস্তক্ষেপ ঘটেছিল তা আগেরবার তেমনটা হয়নি। তবে যেটি হয়েছিল নতুন মাত্রায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী লালন এবং তাদের ক্ষমতায়ন। বেগম জিয়া তাঁর প্রথম আমলের শাসনকালে শেষের দিকে এসে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে করেই হোক তাঁকে ক্ষমতায় থাকতেই হবে । এর সূত্র ধরেই জন্ম হয় মাগুরা উপ-নির্বাচন। তখন কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচন বেগম জিয়ার সরকারের অধীনে কোন অবস্থাতেই অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। এই প্রেক্ষাপটেই শুরু হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন, যে আন্দোলনে বিএনপি ছাড়া সকল রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজ অংশগ্রহণ করে। এক সময় এই আন্দোলনটি একটি মিনি গণআন্দোলনে রূপ নেয়। প্রথমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে বেগম জিয়া এবং তার দলের অনড় অবস্থান থাকলেও শেষ পর্যন্ত জনদাবির মুখে সে দাবি তাঁকে মানতে হয়। তার আগে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের পনেরোই ফেব্রুয়ারির প্রহসনমূলক নির্বাচন যা সকল রাজনৈতিক দল বর্জন করলেও বেগম জিয়ার সঙ্গে অংশগ্রহণ করে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের দল ফ্রিডম পার্টি। সংসদে কুমিল্লার একটি আসন হতে তিনি জিতিয়ে আনেন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ফ্রিডম পার্টির খুনী কর্নেল আবদুর রশিদকে। তাকে তিনি বানান তাঁর এই প্রহসনের সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। সেই সংসদেই পাস হয় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিল। তারপরও তার শেষ রক্ষা হয়নি যদিও তিনি চেষ্টা কম করেননি। তাঁর মনোনীত রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে দিয়ে সামরিক বাহিনীতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করেন যা শেষ মুহূর্তে ভেস্তে যায় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমানের বিচক্ষণতায়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর বেগম জিয়া বুঝতে পারেন ক্ষমতা হারানোর বেদনা কী। শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শাসনকালেও বর্তমানের মতো বেগম জিয়া বছর না পেরুতেই শুরু করেছিলেন সরকারবিরোধী আন্দোলন, তবে সে সময় তার পূর্বেকার আমলের পাপের বোঝা এখনকার মতো এত ভারি ছিল না। বেগম জিয়ার ২০০১-০৬ মেয়াদের সরকার এত পাপ করেছে যে সে পাপের ভারে তিনি আকণ্ঠ নিমজ্জিত এবং ন্যুব্জ। তার পুত্রদের, বিশেষ করে আরাফাত রহমান কোকোর দুর্নীতি তো আন্তর্জাতিক আদালতে স্বীকৃত। নিজে এক এগারোর পর জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করেছেন। বড় ছেলে তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির মামলা আদালতে বিচারাধীন। যে জেনারেল জিয়াকে আর্থিকভাবে একজন সৎ মানুষ হিসাবে তার দলের নেতা নেত্রীরা সব সময় তুলে ধরার চেষ্টা করে সেই জিয়ারই স্ত্রী বেগম জিয়া ক্ষমতায় থাকার সময় ভোগ বিলাসকে এক শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেনা নিবাসের যে বাড়িটি তিনি বেআইনীভাবে দখলে রেখেছিলেন আদালতের নির্দেশে তা ছাড়তে বাধ্য হন। বাড়ি ছাড়ার পর দেশের মানুষ দেখতে পায় ব্যক্তিগত জীবনে একজন ‘সৎ’ জিয়ার স্ত্রীর বিলাসিতা আর ভোগের মাত্রা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। বেগম জিয়ার বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সবচাইতে বড় অপরাধ ছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে তার জোট বাঁধা এবং নির্বাচনের পর দু’জন যুদ্ধাপরাধীকে মন্ত্রী বানানো। ইতিহাসের দৃষ্টিতে তাঁর এই কাজটি ছিল একটি অমার্জনীয় অপরাধ। 
বর্তমান সরকারের আমলে বিএনপির প্রথম হরতালটি ডাকা হয় তাঁর দখলকৃত সেনানিবাসের বাড়ি হতে উচ্ছেদের প্রতিবাদে। তাও কুরবানির ঈদের কয়েকদিন আগে। ব্যক্তিস্বার্থে হরতাল আহ্বান বাংলাদেশে অনেকটা নজিরবিহীন। এই হরতাল সাধারণ মানুষ কখনও ভালভাবে নেয়নি। তারপর তো একের পর এক হরতাল, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং তাতে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। ঢাকার বাইরে অন্য কোন শহরে এমন ধ্বংসাত্মক কর্মকা- অতীতে কখনও না ঘটলে ইদানীং দেখা যাচ্ছে তা চট্টগ্রাম সিলেটের মতো শহরেও ছড়িয়ে পড়ছে। হরতাল ডাকার কারণ হিসাবে যদিও বলা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন মূল কারণ কিন্তু বেগম জিয়ার সন্তানদের ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা। আসলে গত তিন বছরে যা হয়েছে বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে অনেকটা অস্তিত্ব হারিয়ে জামায়াতের পেটের ভিতর ঢুকে পড়েছে। বিএনপি যখন কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী ঘোষণা করে তখন তা আর তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। চালকের আসনে বসে যায় জামায়াত। যে কোন জনসভায় প্রথমে বক্তব্য রাখেন জামায়াতের নেতৃবৃন্দ। তাদের দাবি একটাই। যুদ্ধাপরাধ আর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যাদের বিচার হচ্ছে সেই চিহ্নিত ঘাতকদের মুক্তি। আর্থিকভাবে জামায়াত হচ্ছে এই মুহূর্তে সবচাইতে শক্তিশালী দল। তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটি বড় অংশ বর্তমানে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের মুখোমুখি। এদের সাজা হলে জামায়াতের অস্তিত্ব অনেকাংশে বিলুপ্ত হবে। বিএনপি যদি সামনের বার ক্ষমতায় আসতে না পারে তাহলে দলটির অবস্থা মুসলিম লীগ হয়ে যেতে পারে। সুতরাং এই দু’টি দলই তাদের অস্তিত্বের স্বার্থে জোটবদ্ধ হয়েছে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে। সঙ্গে আছে কিছু হোন্ডা পার্টি। 
বিএনপি-জামায়াত জোট বলে তাদের প্রধান দাবি হচ্ছে আগামী সংসদ নির্বাচন হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। কিন্তু ইতোমধ্যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সে ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে। তাদের দাবি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা সুষ্ঠু হবে না। আওয়ামী লীগ এবং সংসদে তার মিত্ররা বলছে অসংসদীয় ব্যবস্থায় নির্বাচন নয় নির্বাচন হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে এবং সে সরকারে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা থাকবেন। এটি সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তা মানতে নারাজ বিএনপি এবং তার মিত্ররা। তবে তারা তাদের বক্তব্য সংসদে গিয়ে তুলে ধরতেও নারাজ। এমন একটা অচল অবস্থার প্রেক্ষাপটে ইদানীং বিএনপির নেতৃবৃন্দ বলা শুরু করেছেন তারা তাদের আন্দোলনের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান ঘটাবেন এবং তার ফলে বর্তমান সরকারের পতন হবে আর তা যদি হয় তা হলে তাদের ক্ষমতায় আসার পথ সুগম হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে তছনছ করে ২০০৬ সালেও বিএনপি-জামায়াত জোট এমন স্বপ্ন দেখেছিল যা পরবর্তীকালে তাদের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিল। 
বিএনপি ডাক দিলে এখনও তাদের সমাবেশে প্রচুর লোক সমাগম হয়। হওয়াটাই স্বাভাবিক কারণ তারা তো নির্বাচনের সময় প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৩৮ ভাগের সমর্থন পায়। আর সঙ্গে আছে জামায়াতের বেতনভুক ক্যাডার। সুতরাং জনসমাবেশে লোকসমাগম কোন সমস্যাই নয়। তারপরও কোন গণঅভ্যুত্থান হয় না কারণ বিএনপি তাদের বর্তমান আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পরেনি। না পারার অন্যতম কারণ সাধারণ মানুষ দেখেছে তাদের ভোটে বিজয়ী হয়ে বিএনপি কখনও সংসদে গিয়ে তাদের দাবির কথা বলে না। যে আন্দোলনে সাধারণ মানুষের দাবি উপেক্ষিত থাকে সে আন্দোলন কখনও গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে সত্যিকার অর্থে একবারই গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল ১৯৬৯ সালে এবং সামনে থেকে তার নেতৃত্ব দিয়েছিল এদেশের ছাত্র সমাজ। এরশাদবিরোধী আন্দোলন অনেকটা শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন ছিল যেটিকে বড়জোর গণঅন্দোলন বলা যেতে পারে। বর্তমান অবস্থায় বিএনপির পক্ষে কোন গণঅভ্যুত্থান গড়ে তোলা সম্ভব নয় কারণ তারা শহরের বাইরের মানুষকে তাদের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারবে না। গ্রামের অর্থনীতি আগের যে কোন সময়ের চাইতে এখন অনেক না হলেও ভাল। অন্তত মানুষ দু’বেলা লবণ দিয়ে হলেও ভাত খেতে পারে। বেগম জিয়ার শাসনামলে উত্তরবঙ্গে মঙ্গা ফিবছর হানা দিত যা এখন আর দেয় না। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল আছে, একেবারে বেকার তেমন মানুষের সংখ্যা ৫% এর বেশি নয়। বর্তমান সরকারের কিছু ব্যর্থতা সত্ত্বেও এই সব ক্ষেত্রে অর্জন তো মানুষ অস্বীকার করতে পারবে না। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অনেক সমস্যা আছে যা বিএনপি সংসদে গিয়ে তুলে ধরতে পারত যা তারা করে না। সংসদে তারা মাঝে মাঝে যায় তবে তা তাদের আসন ধরে রাখতে। সংসদে না গেলেও তারা একজন সংসদ সদস্যের সকল সুযোগ-সুবিধা নেয়। সাধারণ মানুষ এসবকে কখনও ভালভাবে নেয় না। সত্যিকার অর্থে গণঅভ্যুত্থান গড়ে তুলতে হলে বিএনপিকে তাদের আন্দোলনের সঙ্গে জনমানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তবে সবার আগে তাদের যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের সংশ্রব ত্যাগ করতে হবে। তারেক জিয়া একদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন এমন দিবাস্বপ্ন দেখা হতে আপাতত তাদের বিরত থাকতে হবে। আর তা যদি না হয় আন্দোলনের নামে তারা যা করছে বা করবে বলে নিয়মিত হুঙ্কার ছাড়েন তাতে শুধু সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে কাজের কাজ কিছুই হবে না। 

লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক, জুন ১৫, ২০১২

শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

মধ্যরাতের টকশো সংস্কৃতি আর ‘চারিদিকে অন্ধকার’-এর রাজনীতি

বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মাঝরাতের টকশোগুলো ইদানীং বেশ আলোচিত সমালোচিত হচ্ছে নানা কারণে। দেশে দেশে আড্ডার ছলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে টিভি টকশো বেশ জনপ্রিয়। আর যেহেতু রাজনীতি বাঙালীর অতি প্রিয় একটি বিষয় সেহেতু টিভির কোন টকশোতে বিষয় যদি হয় রাজনীতি তাহলে তার প্রতি সাধারণ দর্শক-শ্রোতার আগ্রহ বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। আসলে এটি এই উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে। অন্য দেশেও টিভি টকশো একশ্রেণীর দর্শক-শ্রোতার কাছে বেশ জনপ্রিয় তবে সেগুলো সব সময় রাজনীতি প্রধান থাকে না। এককালে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় জনি কার্সন অথবা ল্যারি কিং শো দারুণ জনপ্রিয় ছিল। তবে দেখেছি সাধারণত সে দেশের নির্বাচন অথবা কোন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছাড়া তাদের টকশোতে রাজনীতি সবসময় গুরুত্ব পেত না।
বাংলাদেশের প্রায় সকল বেসরকারি টিভি চ্যানেলেই ইদানীং দেখা যায় টিভি টকশোগুলোর প্রধান উপজীব্যই হচ্ছে সরকারের প্রয়োজনে অপ্রোয়জনে সমালোচনা করা। বাংলাদেশের এই টকশো সংস্কৃতি এক ধরনের সবজান্তা বিশেষজ্ঞ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে যারা দুনিয়ার এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে কথা বলেন না। কৃমিনাশে কাল ছাগলের দুধের উপকারিতা হতে শুরু করে মহাশূন্যে বাঙালীর সম্ভাব্য অভিযান। দু’একজন আছেন যারা আলোচিত বিষয়ের সঙ্গে কোন সম্পর্ক না থাকলেও সেখানে সরকার ও আওয়ামী লীগকে টেনে আনবেনই। এদের বেশিরভাগই মোটামুটি ধরে নিয়েছেন আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসছে এবং তাদের কাজ হচ্ছে এই আসাকে ত্বরান্বিত করা। একজন বিজ্ঞ অধ্যাপক বিশেষজ্ঞ তো সে দিন একটি চ্যানেলে বলেই ফেললেন সামনের নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা আরও ফ্যাসিস্ট আচরণ করবে। আর একজন বিশেষজ্ঞ অকপটে বললেন বাংলাদেশ গত চল্লিশ বছরে যা অর্জন করেছে তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর কোন অবদান নেই। এই অর্জন আপনা-আপনিই হতো। শুধু বলতে বাকি রেখেছেন রাজনৈতিক দল বা কোন সরকার না থাকলে দেশ আরও অনেকদূর এগিয়ে যেত। সম্ভবত এরা বাংলাদেশকে সোমালিয়া বা ইথিওপিয়া হিসেবে দেখতে চায়। আবার অনেক প-িতের কিছু ক্লাবও আছে যাদেরকে বলা হয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। দেশের নানা বিষয় নিয়ে তারা সর্বক্ষণ চিন্তা করে রাতের ঘুম হারাম করেন। এটি নিসন্দেহে একটা ভাল উদ্যোগ। তবে সমস্যা হচ্ছে এই প-িতজনেরা প্রায় কেউই বাংলাদেশের কোন ভবিষ্যৎ দেখেন না। তাদের জন্য চারদিকে শুধু অন্ধকার। যখন পশ্চিমা দুনিয়া অর্থনৈতিক মন্দা, যুক্তরাষ্ট্রে আর ইউরোপে কয়েক লাখ মানুষ বেকার এবং দেনার দায়ে হাজার হাজার মানুষ গৃহহারা, মুদ্রস্ফীতি যখন প্রায় দু’অঙ্কের ঘরে তখনও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সীমিত হলেও গতি ছিল। নতুন করে বেকারত্ব বাড়েনি অথবা ওই সব দেশের মতো রাতারাতি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক বীমা কোম্পানি, কলকারখানা বন্ধ হয়নি। তখন একরাতে এই প-িতজনদের একজন এক টিভি টকশোতে বেশ জোর গলায় বললেন, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ না লাগলেও আগামীতে লাগবে এবং যেহেতু তা দেরিতে লাগবে তার প্রস্থানও দেরিতে ঘটবে। যখন তা ঘটল না তখন এদেরই একজন বললেন, আসলে এবার কৃষিতে ফলন ভাল হয়েছে তো সে জন্য অর্থনীতিতে চাপটা বড় করে লাগেনি। তারপরও এঁরা বাংলাদেশের কোন একটি সাফল্যের জন্য সরকারকে কোন ধরনের কৃতিত্ব দিতে নারাজ। আর একজন ভূতপূর্ব আওয়ামী লীগারের কথা বলি। সেটি চারদলীয় জোট সরকারের সময়। ভারত অভিযোগ করেছে তাদের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন তাদের বাংলাদেশী ঘাঁটি হতে ভারতে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালায়। সে বিজ্ঞজন বললেন, এটি ভারতের একটি কল্পনাপ্রসূত অপপ্রচার। বাংলাদেশের মতো এত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কিভাবে অন্য দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ঘাঁটি গাড়তে পারে? 
আসলে বাংলাদেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা কি ঠিক যেমনটি টিভি টকশো বা এক ধরনের গণমাধ্যমে প্রচার করা হয় তত খারাপ? শুধু অর্থনৈতিক অবস্থাটা দেখা যাক। ৭ জুন অর্থমন্ত্রী বর্তমান সরকারের পূর্ণাঙ্গ বাজেট সংসদে উপস্থাপন করেছেন। বাজেট আগামী অর্থ বছরের একটি আর্থিক কর্ম পরিকল্পনা। বিশ্বের কম দেশই আছে যেখানে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। এর প্রধান কারণ কোন একটি দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত কারও একক নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আর এই বিশ্বায়নের যুগে প্রত্যেকটি দেশেই একে অন্যের ওপর তার অর্থনৈতিক কর্মকা-ের অগ্রগতির জন্য নির্ভরশীল। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের মতো ভোগবাদী দেশসমূহে যদি অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় তার ধাক্কা অন্য দেশের ওপর কম-বেশি লাগবেই। তার মাত্রার তারতম্য হতে পারে। তবে কোন দেশ তার অর্থনীতিকে যদি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে তাহলে সেই ঢেউয়ের ধাক্কাটা কম লাগার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিছুদিন আগে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত ড. রব ভস বিশ্ব অর্থনীতির বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকার দেশগুলোকে আগামীতেও অর্থনৈতিক মন্দার ধকল সইতে হবে তাদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ২%-এর উপরে উঠবে না। ভারত তার প্রবৃদ্ধির হার ৯% থেকে কোনভাবে ৬.৯%-এ ধরে রাখতে পেরেছে। আর পাকিস্তানে এই প্রবৃদ্ধি গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, যা ৩.৯% দাঁড়িয়েছে। সেখান বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬.৩% এবং যা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোও স্বীকার করেছে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, এই হিসেবে তিনটি বিষয় যথাÑবাম্পার বোরো ফলন, এপ্রিল মাস থেকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি ও বিদ্যুত উৎপাদনের অর্জন প্রাধান্য পায়নি। অর্থবছরের শেষ মাসের এই বিষয় বিবেচনায় নিলে এই বছরের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের কাছাকাছি অর্জিত হবে। কদাচিৎ কোন টিভি টকশোতে বাংলাদেশের এই সব অর্জনকে তুলে ধরা হয়। হলেও বলা হয় এই অর্জনে সরকারের কোন কৃতিত্ব নেই। এই অর্জনের জন্য কোন কৃতিত্ব দিতে হলে দিতে হবে আমাদের কৃষককে এবং বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের। এটি একটি অদ্ভুত যুক্তি। কৃষিতে যদি সরকার উন্নতমানের বীজ, কমদামে সার, সেচের জন্য বিদ্যুত (তার জন্য আমরা শহরের মানুষ দারুণ কষ্ট পেয়েছি সত্য) না সরবরাহ করলে কি কৃষিতে এই অভাবনীয় সাফল্য আসত ? মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কোরিয়া প্রভৃতি দেশে বাংলাদেশ থেকে যে শ্রমিক যাচ্ছে তাতে কি সরকারের কোন ভূমিকা নেই ? আমাদের শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় কি সারা বছর ধরে ভেরে-া ভাজে? বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলে উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গীবাদ দমনে একটি মডেল হিসেবে পরিচিত হয়েছে। এর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিতও হয়েছেন। এই সব বিষয় সম্পর্কে এই টকশোগুলোতে খুব কমই চর্চা হয়। 
তবে একটা কথা বলতেই হবে। বর্তমান সরকারের পক্ষে গত সাড়ে তিন বছরে যা অর্জন করা সম্ভব ছিল একটু সচেতন হলে আরও বেশি কিছু অর্জন করা যেত। একটি খাত এই সম্ভাবনাকে পিছন থেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে আর তা হচ্ছে আমাদের বিদ্যুত ও জ্বালানি খাত। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে এই খাতকে সব সময় অন্য সব কিছুর ওপর অগ্রাধিকার দিতে হবে, কারণ বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতই হচ্ছে যে কোন দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। সেদিন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় আমার এক প্রাক্তন ছাত্রের সঙ্গে দেখা। সে আক্ষেপ করে জানাল তার একটি নতুন ভোজ্যতেল শোধনাগার, কাগজ কল, লবণ শোধনাগার, পানি বোতলজাত কারখানায় কয়েক শত কোটি টাকা বিনিয়াগের পরও বিদ্যুত সংযোগের অভাবে ঠিক মতো চালু করতে পারছে না। এ রকম উদাহরণ অসংখ্য। এই পরিস্থিতি হতে কিছুটা পরিত্রাণ পেলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৭%-এর ওপরে যাওয়া অসম্ভব ছিল না। তারপর আছে যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এই দুটি খাতকে যতটুকু যতœ দিয়ে পরিচর্যা করার কথা ছিল তা করা হয়নি। গতবারের মতো এবারও বাজেটে বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে বেশ বড় (৫%) বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটি যাদের তত্ত্বাবধানে আছে তাদের দিয়ে মানুষ তেমন ভাল কিছু আশা করে না। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং (অর্থনৈতিক সক্ষমতা) প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড পুওর এর ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দক্ষিণ এশিয়া ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। গত ৬ এপ্রিল বিশ্বের ১২৪ দেশের ওপর করা এই আন্তর্জাতিক সভরেন রেটিং প্রকাশ করা হয়। এই সব বিষয় কখনও মধ্যরাতে প-িতরা তুলে ধরেন না। 
যারা ‘ফ্যাসিস্ট’ আওয়ামী লীগকে আগামীতে আর ক্ষমতায় দেখতে চান না তারা কি চান? বলাবাহুল্য তারা পুনরায় চারদলীয় জামায়াত-বিএনপি জোটকে ক্ষমতায় দেখতে চান। তারা সম্ভবত গোলাম আযম বা মতিউর রহমান নিজামীকে বঙ্গভবনে দেখতে চান। তারা বাংলাদেশকে উগ্র মৌলবাদী উন্মাদ জঙ্গীদের অভয়ারণ্য হিসেবে দেখতে চান। তারা বাংলাদেশকে অবৈধ অস্ত্রের ট্রানজিট রুট হিসেবে দেখতে চান, তারা প্রধানমন্ত্রীর পুত্রদয়ের রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের সংস্কৃতির প্রত্যাবর্তন চান, তারা নতুন হাওয়া ভবনের প্রতিষ্ঠা চান, সর্বোপরি তারা বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান। তারা আরেকটি এক-এগারো দেখতে চান। এই দেখতে চাওয়ার কারণ হচ্ছে তাদের অনেকেই তখন এই সব অপকর্মের পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ অংশীদার বা সুবিধাভোগী হতে পারবেন। তাই বলে কি বর্তমান সরকারের সব কাজ ভাল হচ্ছে তার সনদ দিতে হবে ? মোটেও না। সার্বিক বিচারে বলা যায় বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোটেও সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। ইদানীং সরকারের কিছু লোক কথায় কথায় সব জায়গায় রাষ্ট্রদ্রোহী খোঁজেন। অনেকের বিশ্বাস দেশে যদি একজন রাষ্ট্রদ্রোহীও থাকে তাহলে তা বিদ্যুত বিভাগে। তা যদি না হবে তা হলে এই সময়ে রাত বারটার পরও কেন ঢাকা শহরে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুত বন্ধ হয়? এই লেখাটি বৃহস্পতিবার লিখছি। এদিন সকাল হতে রাত দশটা অবধি ধানম-ির মতো এলাকয় কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুত বন্ধ ছিল। এটি নিত্যদিনের ঘটনা। শুক্রবারও তেমন কোন ব্যতিক্রম দেখা যায় না। আগামী দেড় বছরে শেখ হাসিনাকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে এই পাড়ি দেয়াটা তার জন্য মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ নয়। পাড়ি দিতে হলে তার সঙ্গী-সাথীদের কতজন তার এই দুর্গম পথের সহযাত্রী হবে তা তাকে এখনই ভেবে দেখতে হবে। 
সবশেষে একটি অপ্রিয় কথা না বললেই নয়। বেশ কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে সরকারের কোন কোন সিদ্ধান্ত অথবা নেতাত্রেীদের বক্তব্য বিবৃতির কারণে সরকারের অনেক মিত্র বা শুভাকাক্সক্ষীও সরকারের প্রতিপক্ষ হয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর একটা বড় গুণ ছিল তিনি তার পরম শত্রুকেও আপন করে নিতে পারতেন। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের কোন নেতা-নেত্রীর কাছে এই মহৎ গুণটি দেখা যায়নি। বন্ধু বৃদ্ধির পরিবর্তে শত্রুর চাষ বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর অনেক শুভাকাক্সক্ষীদের ধারণা, সরকার এবং তাঁকে ব্যর্থ প্রমাণ করার জন্য একটি বড় সিন্ডিকেট বর্তমানে বেশ সক্রিয়। এদের অনেকেই বর্ণচোরা। আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি একটু খেয়াল রাখবেন। 

জুন ৮, ২০১২
লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক

বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২

মানুষ কি আবার বানর হওয়ার পথে


আবদুল মান্নান
বর্তমান সমাজে সকলে ছুটছে। কেউ অর্থের পেছনে, কেউবা যশ-খ্যাতির পেছনে। পরিবারের জন্য কারও একটুও সময় নেই। পরিবার ভেঙে পড়ছে দ্রুত। অথচ এই পরিবারই ছিল একসময় বেড়ে ওঠা সন্তানটির মূল্যবোধ শেখার প্রথম পাঠশালা। সেসব পাঠশালা দ্রুত বন্ধ হয়ে পড়ছে। এখন অনেক বাবা-মারই নিজের সন্তানের জন্য সময় থাকে না। সবাই দারুণ ব্যস্ত। এ সময় না থাকার কারণে তাদের সন্তানরা কত উপায়ে বখাটে হচ্ছে সে খবর অনেক অভিভাবকেরই নেই। তারপর একদিন এই সন্তানদের কারণেই পরিবারের সর্বনাশ ঘটে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ কী উপায়ে হতে পারে তা সমাজ বিশ্লেষকদের খুঁজে বের

মানুষের বিবর্তন নিয়ে একাধিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আছে, যার অন্যতম হচ্ছে কয়েক লাখ বছর আগে মানুষের পূর্বপুরুষ বানর (অঢ়ব) ছিল। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমপরিবর্তনের ধারা বজায় রেখে মানুষ তার বর্তমান অবস্থায় আছে। অনেককাল আগে মানুষ সম্পর্কে সম্ভবত জ্ঞান তাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি উক্তি পড়েছিলাম, যাতে তিনি বলেছিলেন মানুষের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, সে তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। ড. শহীদুল্লাহর এই উক্তি সম্ভবত যথার্থ ছিল, অন্তত মানুষের আচরণ দেখলে তাই মনে হবে। এক সপ্তাহের কম সময়ে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলে বোঝা যাবে কেন মনে হচ্ছে মানুষ তার আদি জন্মসূত্রে ফিরে যাচ্ছে। প্রথম ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যে। আলেকজান্ডার কিনিয়া আর কুজো বোনসায়ফো দু'জনই মর্গান স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র। থাকে ছাত্রাবাসের একই কক্ষে। কেন জানি আলেকজান্ডারের মনে হলো তার রুমমেট বন্ধুটির মগজ আর কলজে খেতে বেশ সুস্বাদু হবে। ৩১ মে আলেকজান্ডার ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুজোকে হত্যা করে তার মগজের অংশবিশেষ আর আস্ত কলজেটাই খেয়ে ফেলে। গ্রেফতার হওয়ার পর এ কথা সে অকপটে পুলিশের কাছে স্বীকার করে। ঠিক তার একদিন আগে সুইডেনের প্রখ্যাত কেরলইন্সকা ইনস্টিটিউটের এক অধ্যাপক তার প্রিয়তমা স্ত্রীর ঠোঁট দুটি কেটে নিয়ে গিলে ফেলে। পরে চিকিৎসক আবার তা আগের জায়গায় প্রতিস্থাপন করে। অধ্যাপক পুলিশকে বলেছেন, তিনি তার স্ত্রীকে পরকীয়ার জন্য সন্দেহ করতেন।
এবার একটু দেশের দিকে ফিরে তাকাই। বর্তমান প্রজন্মের পাঠকরা খলিলুল্লাহকে চিনবেন না। ষাটের দশকের শেষ দিকে খলিলুল্লাহকে দেশের সকল মানুষ চিনত। খলিলুল্লাহর বিখ্যাত হওয়ার কারণ তিনি প্রতি রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে প্রবেশ করে সেখানে রাখা মৃতদেহ থেকে কলজে বের করে লবণ দিয়ে কাঁচা চিবিয়ে খেতেন। পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পর খলিলুল্লাহ সহজেই স্বীকার করেন, এই কাজ তিনি বহুদিন ধরেই করছেন এবং তা তিনি বেশ উপভোগ করেন। তার মা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আয়ার কাজ করতেন। এ তো গেল সেই পুরনো দিনের ঘটনা। গত কয়েক দিনে দেশের কয়েকটি স্থানে যে কয়েকটি ঘটনা ঘটল তাতে নিশ্চয় মানুষের পূর্বপুরুষ বানরও লজ্জা পাবে। প্রথম ঘটনাটি ঘটল খোদ রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থল হাতিরপুলে গত ২ জুন। সাইদুর রহমান ওরফে বাচ্চু নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তার তিন বছরের পরিচিত বান্ধবী রুমিকে প্রথমে গলা টিপে হত্যা করে এবং তারপর তার দেহটাকে ঠাণ্ডা মাথায় ২৬ টুকরো করে। নাড়িভুঁড়ি বাথরুমের টয়লেটে ফ্লাশ করার চেষ্টা করে। বাকি টুকরোগুলো পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে ছুড়ে ফেলে সকালে পাখি খাবে বলে। রুমির মাথাটা জানালা দিয়ে ফেলতে অসুবিধা হচ্ছিল বলে তাকে সে কয়েক টুকরো করে। বাচ্চু এতই নৃশংস ছিল যে সে রাতে এই ঘটনা ঘটিয়ে সকালে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দিনের যথারীতি কাজকর্ম শুরু করে। একই দিন চট্টগ্রামে ছোট্ট শিশু রিয়ার লাশ পাওয়া যায় তাদের বাসার সামনে। রিয়া দু'দিন আগে দুপুরবেলায় তাদের বাসার সামনে খেলছিল। সেখান থেকেই তাকে অপহরণ করা হয়। রিয়ার বয়স তিন বছর। রিয়াকে হত্যার অভিযোগে রিয়ার চাচা মোঃ বাদশাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এই ঘটনার কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামে আর একটি ঘটনা ঘটে যায়। সোনা মিয়া আর কাঞ্চনরা সাত বন্ধু। সোনা মিয়ার মোবাইল ফোন সেটটা কে বা কারা চুরি করে। সন্দেহ যায় বন্ধু কাঞ্চনের দিকে। কয়েকজন মিলে কাঞ্চনকে কর্ণফুলী নদীর একটি মাছ ধরার বোটে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারধর করে তাকে নদীতে ফেলে দেয়। পরে পুলিশ এসে কাঞ্চনের লাশ নদী থেকে উদ্ধার করে।
৩১ মে সন্ধ্যায় নাটোরের হালসা বাজার থেকে অপহরণ করা হয় ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র অনন্ত রায়কে। অপহরণকারীরা অনন্তের বাবার কাছ থেকে মোবাইল ফোনে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। অনন্তের বাবা ঘটনাটি পুলিশকে জানালে অপহরণকারীরা অনন্তকে হত্যা করে লাশ বস্তাবন্দি করে একটি পানের বরজের মধ্যে মাটিতে পুঁতে ফেলে। পুলিশ পরে সেখান থেকে সেই লাশ উদ্ধার করে। প্রায় দশ বছর আগে লালমনিরহাটের কন্যাহারা গ্রামের লাইলীর বিয়ে হয় ইমাম হোসেনের সঙ্গে। বিয়ের পর ইমাম হোসেন কাজের সন্ধানে বিদেশ যায়। পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। স্ত্রীর কাছে সবসময় দাবি করে তার পিত্রালয় থেকে নেশা কেনার জন্য টাকা এনে দিতে। তিনি তা করতে ব্যর্থ হলে তাকে প্রায় মারধর করত। গত ৩০ মে ইমাম হোসেন লাইলীর গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। লাইলী এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। গত ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের অভিজাত পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার ফারহাদ ম্যানসনের কয়েকজন তরুণ বাসিন্দা তাদেরই সহপাঠী এবং বন্ধু একটি ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের 'এ' লেভেলের ছাত্র হিমুকে জোর করে চারতলা বাড়ির ছাদে নিয়ে নির্যাতন করে এবং একটি বিদেশি ডোবারম্যান জাতের হিংস্র কুকুর লেলিয়ে দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেয়। গুরুতর আহত হিমু মৃত্যুর সঙ্গে ২৬ দিন লড়াই করে গত ২৩ মে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যায়। এই ঘটনার মূল আসামি জোনায়েদ হোসেন রিয়াদকে তার পরিবার বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করেছে।
ওপরে দেশে এবং দেশের বাইরের যে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হলো তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমন ঘটনা যে কোনো একদিনের পত্রিকা খুললেই পাওয়া যাবে। কোনো ঘটনা ওপরের ঘটনা থেকেও নৃশংস হতে পারে এবং এসব ঘটনা কিন্তু মানুষই ঘটাচ্ছে অন্য কোনো প্রাণী নয়। বলছিলাম, মানুষ আবার তার পূর্বপুরুষ বানরের দিকে ফিরতিযাত্রা শুরু করেছে। বাস্তবে অনেক সময় মনে হয় বানরের বা অন্য প্রাণিকুলের 'মানবিক' গুণাবলি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। একবার গুলশানের এক বিদেশি দূতাবাসে গিয়েছিলাম ভিসার জন্য। হঠাৎ দেখি লোকজনের দৌড়াদৌড়ি। কিছু বোঝার আগেই একজন আমাকে অনেকটা ধাক্কা মেরে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে দেখি অসংখ্য বানর সে দূতাবাস 'আক্রমণ' করেছে । ঘটনা কী জানতে চাইলে ওই দূতাবাসের একজন প্রহরী জানালেন, কয়েকদিন আগে একটি বানর কী করে যেন বিদ্যুৎস্পর্শ হয়ে দূতাবাসের ছাদে মারা পড়ে। এরপর থেকে প্রতিদিন এই বানর পাল কাছের বনানী কবরস্থান থেকে আসে দূতাবাসে হামলা করে তাদের একজন বন্ধুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। বানরদের মধ্যেও এক ধরনের সহমর্মিতা কাজ করে, যা মানুষের মধ্যে অনুপস্থিত।
বলা হয়, মানুষ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কেমন করে এই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির এই দশা হলো। মনুষ্যত্ব একেবারেই উধাও হয়ে গেল। কেমন করে ছেলে বাবাকে, বাবা কন্যাকে, স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, সহপাঠী তার অন্য একজন সহপাঠীকে অথবা ছাত্র শিক্ষককে হত্যা করে? ১৯৮৪ সালের ২৭ মে চট্টগ্রাম কলেজ সোহরাওয়ার্দী ছাত্রাবাসে শাহাদাত নামের এক ছাত্রকে তারই রুমমেট হারুনুর রশীদ জবাই করে হত্যা করেছিল। ইসলামী ছাত্র-শিবিরের কর্মী হারুনের ধারণা, তার রুমমেট ছাত্র ইউনিয়নের শাহাদাত শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হয়ে গর্হিত অপরাধ করছে এবং তার জন্য তার সাজা হওয়া উচিত। এই কাজের জন্য হারুন দিনের বেলায় বাজার থেকে একটি ছুরি কিনে আনে। দু'জনই এইচএসসি ক্লাসের ছাত্র ছিল। সে সময় এই ঘটনা চট্টগ্রামে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এখন হত্যার পর লাশের ২৬ টুকরো না করলে তা আর চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে না। আসলে আমাদের ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার নৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধে একটি প্রচণ্ড রকমের ধস নেমেছে। বর্তমান সমাজে সকলে ছুটছে। কেউ অর্থের পেছনে, কেউবা যশ-খ্যাতির পেছনে। পরিবারের জন্য কারও একটুও সময় নেই। পরিবার ভেঙে পড়ছে দ্রুত। অথচ এই পরিবারই ছিল একসময় বেড়ে ওঠা সন্তানটির মূল্যবোধ শেখার প্রথম পাঠশালা। সেসব পাঠশালা দ্রুত বন্ধ হয়ে পড়ছে। এখন অনেক বাবা-মারই নিজের সন্তানের জন্য সময় থাকে না। সবাই দারুণ ব্যস্ত। এ সময় না থাকার কারণে তাদের সন্তানরা কত উপায়ে বখাটে হচ্ছে সে খবর অনেক অভিভাবকেরই নেই। তারপর একদিন এই সন্তানদের কারণেই পরিবারের সর্বনাশ ঘটে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ কী উপায়ে হতে পারে তা সমাজ বিশ্লেষকদের খুঁজে বের করতে হবে। আর সেটি সম্ভব না হলে মানুষ তার পূর্বপুরুষদের দিকে সম্ভবত আরও দ্রুত ফিরে যাবে।

আবদুল মান্নান :সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক