বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২

মানুষ কি আবার বানর হওয়ার পথে


আবদুল মান্নান
বর্তমান সমাজে সকলে ছুটছে। কেউ অর্থের পেছনে, কেউবা যশ-খ্যাতির পেছনে। পরিবারের জন্য কারও একটুও সময় নেই। পরিবার ভেঙে পড়ছে দ্রুত। অথচ এই পরিবারই ছিল একসময় বেড়ে ওঠা সন্তানটির মূল্যবোধ শেখার প্রথম পাঠশালা। সেসব পাঠশালা দ্রুত বন্ধ হয়ে পড়ছে। এখন অনেক বাবা-মারই নিজের সন্তানের জন্য সময় থাকে না। সবাই দারুণ ব্যস্ত। এ সময় না থাকার কারণে তাদের সন্তানরা কত উপায়ে বখাটে হচ্ছে সে খবর অনেক অভিভাবকেরই নেই। তারপর একদিন এই সন্তানদের কারণেই পরিবারের সর্বনাশ ঘটে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ কী উপায়ে হতে পারে তা সমাজ বিশ্লেষকদের খুঁজে বের

মানুষের বিবর্তন নিয়ে একাধিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আছে, যার অন্যতম হচ্ছে কয়েক লাখ বছর আগে মানুষের পূর্বপুরুষ বানর (অঢ়ব) ছিল। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমপরিবর্তনের ধারা বজায় রেখে মানুষ তার বর্তমান অবস্থায় আছে। অনেককাল আগে মানুষ সম্পর্কে সম্ভবত জ্ঞান তাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি উক্তি পড়েছিলাম, যাতে তিনি বলেছিলেন মানুষের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, সে তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। ড. শহীদুল্লাহর এই উক্তি সম্ভবত যথার্থ ছিল, অন্তত মানুষের আচরণ দেখলে তাই মনে হবে। এক সপ্তাহের কম সময়ে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলে বোঝা যাবে কেন মনে হচ্ছে মানুষ তার আদি জন্মসূত্রে ফিরে যাচ্ছে। প্রথম ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যে। আলেকজান্ডার কিনিয়া আর কুজো বোনসায়ফো দু'জনই মর্গান স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র। থাকে ছাত্রাবাসের একই কক্ষে। কেন জানি আলেকজান্ডারের মনে হলো তার রুমমেট বন্ধুটির মগজ আর কলজে খেতে বেশ সুস্বাদু হবে। ৩১ মে আলেকজান্ডার ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুজোকে হত্যা করে তার মগজের অংশবিশেষ আর আস্ত কলজেটাই খেয়ে ফেলে। গ্রেফতার হওয়ার পর এ কথা সে অকপটে পুলিশের কাছে স্বীকার করে। ঠিক তার একদিন আগে সুইডেনের প্রখ্যাত কেরলইন্সকা ইনস্টিটিউটের এক অধ্যাপক তার প্রিয়তমা স্ত্রীর ঠোঁট দুটি কেটে নিয়ে গিলে ফেলে। পরে চিকিৎসক আবার তা আগের জায়গায় প্রতিস্থাপন করে। অধ্যাপক পুলিশকে বলেছেন, তিনি তার স্ত্রীকে পরকীয়ার জন্য সন্দেহ করতেন।
এবার একটু দেশের দিকে ফিরে তাকাই। বর্তমান প্রজন্মের পাঠকরা খলিলুল্লাহকে চিনবেন না। ষাটের দশকের শেষ দিকে খলিলুল্লাহকে দেশের সকল মানুষ চিনত। খলিলুল্লাহর বিখ্যাত হওয়ার কারণ তিনি প্রতি রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে প্রবেশ করে সেখানে রাখা মৃতদেহ থেকে কলজে বের করে লবণ দিয়ে কাঁচা চিবিয়ে খেতেন। পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পর খলিলুল্লাহ সহজেই স্বীকার করেন, এই কাজ তিনি বহুদিন ধরেই করছেন এবং তা তিনি বেশ উপভোগ করেন। তার মা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আয়ার কাজ করতেন। এ তো গেল সেই পুরনো দিনের ঘটনা। গত কয়েক দিনে দেশের কয়েকটি স্থানে যে কয়েকটি ঘটনা ঘটল তাতে নিশ্চয় মানুষের পূর্বপুরুষ বানরও লজ্জা পাবে। প্রথম ঘটনাটি ঘটল খোদ রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থল হাতিরপুলে গত ২ জুন। সাইদুর রহমান ওরফে বাচ্চু নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তার তিন বছরের পরিচিত বান্ধবী রুমিকে প্রথমে গলা টিপে হত্যা করে এবং তারপর তার দেহটাকে ঠাণ্ডা মাথায় ২৬ টুকরো করে। নাড়িভুঁড়ি বাথরুমের টয়লেটে ফ্লাশ করার চেষ্টা করে। বাকি টুকরোগুলো পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে ছুড়ে ফেলে সকালে পাখি খাবে বলে। রুমির মাথাটা জানালা দিয়ে ফেলতে অসুবিধা হচ্ছিল বলে তাকে সে কয়েক টুকরো করে। বাচ্চু এতই নৃশংস ছিল যে সে রাতে এই ঘটনা ঘটিয়ে সকালে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দিনের যথারীতি কাজকর্ম শুরু করে। একই দিন চট্টগ্রামে ছোট্ট শিশু রিয়ার লাশ পাওয়া যায় তাদের বাসার সামনে। রিয়া দু'দিন আগে দুপুরবেলায় তাদের বাসার সামনে খেলছিল। সেখান থেকেই তাকে অপহরণ করা হয়। রিয়ার বয়স তিন বছর। রিয়াকে হত্যার অভিযোগে রিয়ার চাচা মোঃ বাদশাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এই ঘটনার কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামে আর একটি ঘটনা ঘটে যায়। সোনা মিয়া আর কাঞ্চনরা সাত বন্ধু। সোনা মিয়ার মোবাইল ফোন সেটটা কে বা কারা চুরি করে। সন্দেহ যায় বন্ধু কাঞ্চনের দিকে। কয়েকজন মিলে কাঞ্চনকে কর্ণফুলী নদীর একটি মাছ ধরার বোটে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারধর করে তাকে নদীতে ফেলে দেয়। পরে পুলিশ এসে কাঞ্চনের লাশ নদী থেকে উদ্ধার করে।
৩১ মে সন্ধ্যায় নাটোরের হালসা বাজার থেকে অপহরণ করা হয় ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র অনন্ত রায়কে। অপহরণকারীরা অনন্তের বাবার কাছ থেকে মোবাইল ফোনে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। অনন্তের বাবা ঘটনাটি পুলিশকে জানালে অপহরণকারীরা অনন্তকে হত্যা করে লাশ বস্তাবন্দি করে একটি পানের বরজের মধ্যে মাটিতে পুঁতে ফেলে। পুলিশ পরে সেখান থেকে সেই লাশ উদ্ধার করে। প্রায় দশ বছর আগে লালমনিরহাটের কন্যাহারা গ্রামের লাইলীর বিয়ে হয় ইমাম হোসেনের সঙ্গে। বিয়ের পর ইমাম হোসেন কাজের সন্ধানে বিদেশ যায়। পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। স্ত্রীর কাছে সবসময় দাবি করে তার পিত্রালয় থেকে নেশা কেনার জন্য টাকা এনে দিতে। তিনি তা করতে ব্যর্থ হলে তাকে প্রায় মারধর করত। গত ৩০ মে ইমাম হোসেন লাইলীর গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। লাইলী এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। গত ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের অভিজাত পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার ফারহাদ ম্যানসনের কয়েকজন তরুণ বাসিন্দা তাদেরই সহপাঠী এবং বন্ধু একটি ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের 'এ' লেভেলের ছাত্র হিমুকে জোর করে চারতলা বাড়ির ছাদে নিয়ে নির্যাতন করে এবং একটি বিদেশি ডোবারম্যান জাতের হিংস্র কুকুর লেলিয়ে দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেয়। গুরুতর আহত হিমু মৃত্যুর সঙ্গে ২৬ দিন লড়াই করে গত ২৩ মে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যায়। এই ঘটনার মূল আসামি জোনায়েদ হোসেন রিয়াদকে তার পরিবার বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করেছে।
ওপরে দেশে এবং দেশের বাইরের যে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হলো তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমন ঘটনা যে কোনো একদিনের পত্রিকা খুললেই পাওয়া যাবে। কোনো ঘটনা ওপরের ঘটনা থেকেও নৃশংস হতে পারে এবং এসব ঘটনা কিন্তু মানুষই ঘটাচ্ছে অন্য কোনো প্রাণী নয়। বলছিলাম, মানুষ আবার তার পূর্বপুরুষ বানরের দিকে ফিরতিযাত্রা শুরু করেছে। বাস্তবে অনেক সময় মনে হয় বানরের বা অন্য প্রাণিকুলের 'মানবিক' গুণাবলি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। একবার গুলশানের এক বিদেশি দূতাবাসে গিয়েছিলাম ভিসার জন্য। হঠাৎ দেখি লোকজনের দৌড়াদৌড়ি। কিছু বোঝার আগেই একজন আমাকে অনেকটা ধাক্কা মেরে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে দেখি অসংখ্য বানর সে দূতাবাস 'আক্রমণ' করেছে । ঘটনা কী জানতে চাইলে ওই দূতাবাসের একজন প্রহরী জানালেন, কয়েকদিন আগে একটি বানর কী করে যেন বিদ্যুৎস্পর্শ হয়ে দূতাবাসের ছাদে মারা পড়ে। এরপর থেকে প্রতিদিন এই বানর পাল কাছের বনানী কবরস্থান থেকে আসে দূতাবাসে হামলা করে তাদের একজন বন্ধুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। বানরদের মধ্যেও এক ধরনের সহমর্মিতা কাজ করে, যা মানুষের মধ্যে অনুপস্থিত।
বলা হয়, মানুষ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কেমন করে এই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির এই দশা হলো। মনুষ্যত্ব একেবারেই উধাও হয়ে গেল। কেমন করে ছেলে বাবাকে, বাবা কন্যাকে, স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, সহপাঠী তার অন্য একজন সহপাঠীকে অথবা ছাত্র শিক্ষককে হত্যা করে? ১৯৮৪ সালের ২৭ মে চট্টগ্রাম কলেজ সোহরাওয়ার্দী ছাত্রাবাসে শাহাদাত নামের এক ছাত্রকে তারই রুমমেট হারুনুর রশীদ জবাই করে হত্যা করেছিল। ইসলামী ছাত্র-শিবিরের কর্মী হারুনের ধারণা, তার রুমমেট ছাত্র ইউনিয়নের শাহাদাত শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হয়ে গর্হিত অপরাধ করছে এবং তার জন্য তার সাজা হওয়া উচিত। এই কাজের জন্য হারুন দিনের বেলায় বাজার থেকে একটি ছুরি কিনে আনে। দু'জনই এইচএসসি ক্লাসের ছাত্র ছিল। সে সময় এই ঘটনা চট্টগ্রামে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এখন হত্যার পর লাশের ২৬ টুকরো না করলে তা আর চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে না। আসলে আমাদের ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার নৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধে একটি প্রচণ্ড রকমের ধস নেমেছে। বর্তমান সমাজে সকলে ছুটছে। কেউ অর্থের পেছনে, কেউবা যশ-খ্যাতির পেছনে। পরিবারের জন্য কারও একটুও সময় নেই। পরিবার ভেঙে পড়ছে দ্রুত। অথচ এই পরিবারই ছিল একসময় বেড়ে ওঠা সন্তানটির মূল্যবোধ শেখার প্রথম পাঠশালা। সেসব পাঠশালা দ্রুত বন্ধ হয়ে পড়ছে। এখন অনেক বাবা-মারই নিজের সন্তানের জন্য সময় থাকে না। সবাই দারুণ ব্যস্ত। এ সময় না থাকার কারণে তাদের সন্তানরা কত উপায়ে বখাটে হচ্ছে সে খবর অনেক অভিভাবকেরই নেই। তারপর একদিন এই সন্তানদের কারণেই পরিবারের সর্বনাশ ঘটে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ কী উপায়ে হতে পারে তা সমাজ বিশ্লেষকদের খুঁজে বের করতে হবে। আর সেটি সম্ভব না হলে মানুষ তার পূর্বপুরুষদের দিকে সম্ভবত আরও দ্রুত ফিরে যাবে।

আবদুল মান্নান :সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন