আবদুল মান্নান
আমাদের একেবারে বাড়ির পাশে বর্মা মুলুকে অনেককাল ধরে সরকারীভাবে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে জাতিগত দাঙ্গার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার অভিযান চলছে এবং তা দেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একেবারে চুপ। বর্মা মুলুকের বর্তমান নাম মিয়ানমার। দেশটি প্রায় অর্ধশতক ধরে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। সম্প্রতি সে দেশে আবার গণতান্ত্রিক ধারা ফিরতে শুরু করেছে বলে বিশ্ব সম্প্রদায় মনে করে। তাদের ধারণা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্যাতনের বিষয়ে বেশি চাপাচাপি করলে সে দেশে আবার গণতন্ত্র হুমকির সামনে পড়তে পারে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ মুক্ত মানুষ হিসেবে বাস করতে পারা উচিত। তা যদি না-ই হবে তাহলে সে দেশকে কোনভাবেই গণতান্ত্রিক দেশ বলা যাবে না। অবশ্য পশ্চিমা বিশ্বের একেকটি দেশের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা আবার একেক রকম। যে মানুষগুলো সে দেশে নির্যাতিত হচ্ছে তারা জাতে রোহিঙ্গা, ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান। বেশিরভাগেরই আবাস উত্তর আরাকান প্রদেশে। তারা সেখানে কিভাবে এলো তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। কোন কোন ইতিহাসবিদ মনে করেন, রোহিঙ্গারা আরব দেশ থেকে এসে সেখানে বসতি গেঁড়েছিল সেই অষ্টম শতকে। কারও কারও মতে, তারা ভারতবর্ষের গুজরাট অঞ্চল ও আফগানিস্তান হতে সেখানে হিযরত করে চাষবাস শুরু করেছিল। এলাকাটি চট্টগ্রামের সংলগ্ন হওয়াতে তাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের মানুষের উঠবস বেশি ছিল। তাদের ভাষার সঙ্গে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার বেশ মিল আছে। যেখান থেকেই তারা আসুক না কেন তারা এখন মিয়ানমারের অধিবাসী। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে পরবর্র্তীকালের মিয়ানমারের কোন সরকারই তা স্বীকার করেনি এবং যুগ যুগ ধরে তারা নির্যাতিত হয়েছে। বর্মার সরকার সব সময় মনে করে, বর্মায় একেবারে স্থানীয় ও বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ছাড়া সকলেই বহিরাগত। ভারতীয় হলে তো কথাই নেই। বর্তমানে সে দেশে প্রায় ত্রিশ লাখ ভারতীয় বংশদ্ভূত মানুষ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বাস করে। চীনা ও মালয়ের মুসলমানদের অবস্থাও একই রকম। তবে তাদের সংখ্যা রোহিঙ্গাদের চাইতে কম। কথায় কথায় সকলে নির্যাতন এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়। সে দেশে ১৩৫টি আদিবাসীকে সরকারীভাবে নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী বলে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। বাদ পড়েছে শুধু রোহিঙ্গারা। তাদের অপরাধ তারা ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান এবং গায়ের রং কালো।
এবার আমার বাবার কথা বলি। ত্রিশের দশকে তাঁর যৌবনকাল। ভাগ্য ফেরাতে ছুটলেন বর্মা মুলুকে। তখন অবিভক্ত বাংলার তো বটেই ভারতবর্ষের মানুষ ভাগ্যান্বেষণে ছুটতেন রেঙ্গুন না হয় আকিয়াবে। এই অঞ্চলের একমাত্র সমৃদ্ধশালী দেশ তখন বর্মা। চট্টগ্রামের মানুষ সমুদ্রপথে এক সকালে যাত্রা করে পরদিন আকিয়াব পৌঁছে যেত, কয়েকদিন পর রেঙ্গুন বন্দরে। সে দেশে বিয়েশাদীও করেছেন অনেকে। বাবা ছোটখাটো একটা রেস্টুরেন্ট খুলে বসেছিলেন। তবে তাঁর দোকানের বেশিরভাগ খদ্দের ভারতীয়। কদাচ কোন স্থানীয় মানুষ দোকানে প্রবেশ করত। বাবা-চাচাদের কাছে শুনেছি, বার্মিজ মেয়েদের কাছে ভারতীয় পুরুষদের কদর ছিল বেশ। তাদের বিয়ে করার এক ধরনের আকুতিও নাকি ছিল । অবশ্য তিনি সে খপ্পরে পড়েননি। আয় রোজগার ভাল। ব্যাচেলর মানুষ। কিছু টাকা জমিয়ে একটা গাড়িও নাকি কিনেছিলেন। ট্যাক্সি হিসেবে চলত। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। জাপানীদের হাতে সিঙ্গাপুর পতনের পর ১৯৪২ সালে বর্মার পতন হলো। বাবা বলতেন বার্মিজরা সম্ভবত এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিল। প্রথম সুযোগেই জাপানী সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে শুরু করে দিল ভয়াবহ দাঙ্গা। এটি ছিল ভারতীয়দের বর্মা থেকে উৎখাত করার দাঙ্গা। বাবা হাজার হাজার ভারতীয়ের সঙ্গে এককাপড়ে হেঁটে রওনা দিলেন দেশের উদ্দেশ্যে। প্রায় একমাস চলার পর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় চট্টগ্রাম পৌঁছেছিলেন। পথে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
বর্মায় বর্ণ এবং জাতিবিদ্বেষ এখনও প্রকটভাবে বিদ্যমান। অথচ এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্পূর্ণ নীরব। বর্মায় বসবাসরত নাগরিকদের দু’ধরনের পরিচয়পত্র দেয়া হয়। একটি লাল রং-এর অন্যটি সাদা। লালটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বার্মিজদের। অন্যটি সাদা, পেছনে লেখা থাকে এই কার্ডধারী বর্মার নাগরিক নয়। রোহিঙ্গাদের কার্ডের পেছনে লেখা থাকে; এর বাহক একজন বাঙালী মুসলমান। এটি একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার যে একবিংশ শতকে এসেও নাৎসি জার্মানির একটি মডেল রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নিয়েছে এবং ইদানীং সকলে মিয়ানমারের নতুন সরকারকে হাত কচলে বেশ খোশামোদ করছে।
উত্তর আরাকান প্রদেশ বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা। এখানকার রোহিঙ্গারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের হাতেই সর্বাধিক নিগৃহীত হয়। এদের বিয়ে করতে হলে প্রশাসন থেকে পূর্বানুমতি নিতে হয়, যা সচরাচর মিলে না। বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না। রোহিঙ্গাদের এখান হতে অন্য প্রদেশে যাওয়া বেআইনী। মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশ বাহিনীতে কোন রোহিঙ্গা মুসলমানের চাকরি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। স্থানীয় রাখাইনরা সুযোগ পেলেই দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু করে। এসবের কোন বিচার কখনও হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরাকান রাজ্যে প্রথম বড় ধরনের দাঙ্গা হয় ১৯৬২ সালে। তখন কয়েক হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু কক্সবাজার হয়ে চট্টগ্রাম প্রবেশ করে। কয়েক হাজার থাইল্যান্ডেও চলে যায়। সে সময় যারা চট্টগ্রামে এসেছিল পরবর্তীকালে তারা এখানকার মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ভিটামাটি হতে উচ্ছেদ হয়ে রোহিঙ্গাদের প্রথম অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৭৮ এবং ১৯৭৯ সালে যখন আরাকানে বর্মার সেনাবাহিনী অপারেশন ‘নাগামিন’ নামে একটি জাতিগত শুদ্ধি অভিযান শুরু করে। সে ধাক্কায় বাংলাদেশে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সমস্যাটির কোন কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা না করে নাফ নদীতে নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ পাঠায়। সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। পাল্টা বর্মাও একই কাজ করে। কিন্তু সমস্যা সমস্যাই থেকে যায়। আরেকটি ধাক্কা আসে ১৯৯০-৯১ সালে যখন প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার এমন অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ করার জন্য একটি দেশও বাংলাদেশের পাশে কার্যকরভাবে দাঁড়ায়নি। শুধু জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা কিছু রিলিফসামগ্রী নিয়ে কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া, কুতুপালং প্রভৃতি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে তাদের পাশে দাঁড়ায় তবে তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বর্তমানে সরকারীভাবে দু’টি শরণার্থী শিবির আছে। বাংলাদেশ মাঝে মাঝে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সে দেশে ফেরত পাঠাতে কয়েকবার চেষ্টা করেও তেমন একটা সফল হয়নি। তারা শুধু কয়েক হাজার শরণার্থীকে ফিরিয়ে নিয়ে সাফ জানিয়ে দেয়Ñ বাকিরা তাদের দেশের নাগরিক নয়। বাংলাদেশের মতো একটা দেশের পক্ষে সম্ভব নয় কয়েক লাখ শরণার্থীকে বছরের পর বছর চারদিকে তারকাঁটার বেড়া দিয়ে আটক করে রাখা। বর্তমানে দুই ক্যাম্পে শুধু ত্রিশ হাজারের মতো তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা আছে বাকিরা দেশের জনারণ্যে মিশে গেছে এবং বিভিন্ন সময় তারা একশ্রেণীর দালাল আর অসাধু সরকারী কর্মকর্তাদের সহায়তায় বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে শুধু চলেই যায়নি সেসব দেশে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের সুনামের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে তাদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশে মাদক ব্যবসা এবং নারী ও শিশু পাচারসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে কয়েক শ’ রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম শহরে চলে এসেছে। চট্টগ্রাম এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের চারপাশের সকল খালি জায়গা ইতোমধ্যে তাদের দখলে চলে গেছে। এলাকাটি হয়ে পড়েছে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। তবে সব চাইতে যেটি ভয়াবহ সমস্যা এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো এখন জঙ্গী তৈরির প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এদের নিয়ে গোপনে কাজ করে সৌদি আরবভিত্তিক রাবিতাত আল ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, হেফাজতে ইসলামসহ অনেক ধর্মান্ধ মৌলবাদী দল ও জঙ্গীবাদী সংগঠন।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সবচাইতে হতাশাজনক ভূমিকা পালন করেছে গণতন্ত্রের মানসকন্যা খ্যাত আউন সান সুচি। এ ব্যাপারে তার কোন কার্যকর ভূমিকা চোখে পড়ে না। সম্প্রতি তিনি অসলোতে একুশ বছর পূর্বে তাকে প্রদত্ত শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার নিতে গিয়ে তাঁর বক্তৃতায় বলেনÑপ্রবাসী বার্মিজরা মিয়ানমারে সকল নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মাঝে শান্তি ফিরিয়ে আনতে গুরুপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যস, ওটুকুই ।
সম্প্রতি নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রবেশকে কেন্দ্র করে নানা বিতর্কের জন্ম হয়েছে। সরকার নতুন করে কোন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দিতে নারাজ। সার্বিক বিচারে এটি সরকারের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে অনেকে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, সরকারের উচিত আরও একটু মানবিক হওয়া। এই প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট কয়েক ব্যক্তি ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েছেন। জামায়াত-বিএনপি বলেছে, সরকারের উচিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া। একজন সিনিয়র সাংবাদিক কলাম লিখে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের যেন আবার বাঘের মুখে ঠেলে দেয়া না হয়। সরকারী দলের এক সংসদ সদস্য পত্রিকায় মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে বলেছেনÑরোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখে তার রাতে ঘুম হয় না। জাতিসংঘ আর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে। জামায়াত আর বিএনপির বলার মধ্যে একটা বড় বদমতলব আছে। বিএনপি আমলে এই রোহিঙ্গাদের অনেকেই ভোটার হয়েছে। সে ভোট তাদের বাক্সে পড়বে। তাদের আমলেই সবচাইতে বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গেছে। জামায়াত ও সমমনা দল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এদেরকে তাদের জিহাদী আর সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করবে। এদের প্রতি আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায়ের জন্য এরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কার বিখ্যাত মাইলাই গণহত্যার একটি ছবি তারা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ছবি বলে ইন্টারনেটে আপলোড করেছে। অন্য আর একটি ছবি আছে যেটি আসলে থাই পুলিশের হাতে ধৃত গোটাপঞ্চাশেক রোহিঙ্গার। পুলিশ তাদের সমুদ্রের বালিতে উপুড় করে শুয়ে রেখেছে। কিন্তু ছবির ক্যাপসান দেয়া আছে বর্মার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মেরে ফেলে রেখেছে। টেকনাফে এখন কিছু মোবাইল ফোনের দোকানে কিছু হিন্দী ছবির নির্যাতনের দৃশ্যের ক্লিপিং পাওয়া যায় যা রোহিঙ্গা নির্যাতনের ছবি হিসেবে মোবাইলে ডাউনলোড করে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এটি সত্য, সাম্প্রতিক দাঙ্গায় অনেক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে, অনেক নারী ধর্ষিত হয়েছে। তবে এই ছবিগুলোর কোনটাই সে সবের নয়। টেকনাফ আর কক্সবাজারে জামায়াতের নেটওয়ার্ক বেশ শক্তিশালী। শোনা যায়, অনেক রোহিঙ্গা গোপনে জামায়াতীদের বাড়িতেও আশ্রয় নিয়েছে। পুরো এলাকা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার দাবি সংবলিত পোস্টারে ছেয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা এখানে নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব এলাকার দিনমজুরদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ দানা বাঁধছে। কারণ যেখানে একজন দিনমজুরের দৈনিক পারিশ্রমিক দেড় থেকে দুই শ’ টাকা সেখানে একজন রোহিঙ্গা শ্রমিক পাওয়া যায় পঞ্চাশ টাকা দিয়ে। যাঁরা মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে বলেন তাঁরা এখানকার বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত নন। বাংলাদেশ অতীতে সব সময় মানবিক আচরণ করেছে, এখনও করছে। কিন্তু তাতে ফলাফল শূন্য। এ সম্পর্কে আমাদের বিশিষ্টজনরা একেবারেই নিশ্চুপ।
কেউ কেউ অনেকটা অর্বাচীনের মতো রোহিঙ্গাদের সমস্যাকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেন। একাত্তর সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করছিলাম। সেই যুদ্ধে এক কোটি বাঙালী শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমরা একটা প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলাম। শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তারা যাতে নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যায় সে চেষ্টা করেছিল ভারত। যুদ্ধ শেষে দ্রুততম সময়ে প্রত্যেক বাংলাদেশী নিজ দেশে ফিরে এসেছিলেন। ভারতে থেকে গিয়েছে তেমন বাঙালী হাতে গোনা যায়। একাত্তরের বাংলাদেশের শরণার্থীদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের তুলনা করা চরম মূর্খতার শামিল।
এটি ঠিক মিয়ানমার বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। তাদের সঙ্গে আমাদের অনেক অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। তবুও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ চুপ থাকতে পারে না। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহল থেকে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য সকল ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। প্রয়োজনে বিষয়টা জাতিসংঘের নজরে আনতে হবে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা ভারত তেমন কিছু করবে বলে মনে হয় না। কারণ নতুন মিয়ানমারের অফুরন্ত সম্পদ ও সম্ভাবনার দিকে এখন তাদের সকলের লোলুপ দৃষ্টি। সকলে নিজের স্বার্থ রক্ষাকে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দেয়। কিছুদিনের মধ্যে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে। বাংলাদেশকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করার বিষয়ে নিশ্চয় আলাপ হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার মতো একটি সমস্যা জিইয়ে রেখে কোন সম্পর্কই যে কার্যকর হবে না তা তাকে বুঝতে দিতে হবে। বাংলাদেশ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সমস্যার মীমাংসা করেছে। এই সমস্যারও সমাধান হবে, তা মানুষ আশা করতেই পারে। এটি যত না গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য তার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মিয়ানমারের জন্য। এর ব্যত্যয় ঘটলে একটি নতুন গণতান্ত্রিক মিয়ানমারের অভ্যুদয় অধরাই থেকে যাবে।
বিএনপি-জামায়াতের কথা বাদ দিলাম। বাকি যাঁরা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে ওকালতি করছেন তাঁদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছিÑবাস্তবতাটা উপলব্ধি করুন, নিজের দেশের স্বার্থটাকে সবার ওপর স্থান দিন। এখনও বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণ রোহিঙ্গাদের প্রতি অনেক মানবিক আচরণ করছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক। জুন ২২, ২০১২
আমাদের একেবারে বাড়ির পাশে বর্মা মুলুকে অনেককাল ধরে সরকারীভাবে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে জাতিগত দাঙ্গার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার অভিযান চলছে এবং তা দেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একেবারে চুপ। বর্মা মুলুকের বর্তমান নাম মিয়ানমার। দেশটি প্রায় অর্ধশতক ধরে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। সম্প্রতি সে দেশে আবার গণতান্ত্রিক ধারা ফিরতে শুরু করেছে বলে বিশ্ব সম্প্রদায় মনে করে। তাদের ধারণা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্যাতনের বিষয়ে বেশি চাপাচাপি করলে সে দেশে আবার গণতন্ত্র হুমকির সামনে পড়তে পারে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ মুক্ত মানুষ হিসেবে বাস করতে পারা উচিত। তা যদি না-ই হবে তাহলে সে দেশকে কোনভাবেই গণতান্ত্রিক দেশ বলা যাবে না। অবশ্য পশ্চিমা বিশ্বের একেকটি দেশের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা আবার একেক রকম। যে মানুষগুলো সে দেশে নির্যাতিত হচ্ছে তারা জাতে রোহিঙ্গা, ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান। বেশিরভাগেরই আবাস উত্তর আরাকান প্রদেশে। তারা সেখানে কিভাবে এলো তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। কোন কোন ইতিহাসবিদ মনে করেন, রোহিঙ্গারা আরব দেশ থেকে এসে সেখানে বসতি গেঁড়েছিল সেই অষ্টম শতকে। কারও কারও মতে, তারা ভারতবর্ষের গুজরাট অঞ্চল ও আফগানিস্তান হতে সেখানে হিযরত করে চাষবাস শুরু করেছিল। এলাকাটি চট্টগ্রামের সংলগ্ন হওয়াতে তাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের মানুষের উঠবস বেশি ছিল। তাদের ভাষার সঙ্গে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার বেশ মিল আছে। যেখান থেকেই তারা আসুক না কেন তারা এখন মিয়ানমারের অধিবাসী। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে পরবর্র্তীকালের মিয়ানমারের কোন সরকারই তা স্বীকার করেনি এবং যুগ যুগ ধরে তারা নির্যাতিত হয়েছে। বর্মার সরকার সব সময় মনে করে, বর্মায় একেবারে স্থানীয় ও বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ছাড়া সকলেই বহিরাগত। ভারতীয় হলে তো কথাই নেই। বর্তমানে সে দেশে প্রায় ত্রিশ লাখ ভারতীয় বংশদ্ভূত মানুষ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বাস করে। চীনা ও মালয়ের মুসলমানদের অবস্থাও একই রকম। তবে তাদের সংখ্যা রোহিঙ্গাদের চাইতে কম। কথায় কথায় সকলে নির্যাতন এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়। সে দেশে ১৩৫টি আদিবাসীকে সরকারীভাবে নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী বলে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। বাদ পড়েছে শুধু রোহিঙ্গারা। তাদের অপরাধ তারা ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান এবং গায়ের রং কালো।
এবার আমার বাবার কথা বলি। ত্রিশের দশকে তাঁর যৌবনকাল। ভাগ্য ফেরাতে ছুটলেন বর্মা মুলুকে। তখন অবিভক্ত বাংলার তো বটেই ভারতবর্ষের মানুষ ভাগ্যান্বেষণে ছুটতেন রেঙ্গুন না হয় আকিয়াবে। এই অঞ্চলের একমাত্র সমৃদ্ধশালী দেশ তখন বর্মা। চট্টগ্রামের মানুষ সমুদ্রপথে এক সকালে যাত্রা করে পরদিন আকিয়াব পৌঁছে যেত, কয়েকদিন পর রেঙ্গুন বন্দরে। সে দেশে বিয়েশাদীও করেছেন অনেকে। বাবা ছোটখাটো একটা রেস্টুরেন্ট খুলে বসেছিলেন। তবে তাঁর দোকানের বেশিরভাগ খদ্দের ভারতীয়। কদাচ কোন স্থানীয় মানুষ দোকানে প্রবেশ করত। বাবা-চাচাদের কাছে শুনেছি, বার্মিজ মেয়েদের কাছে ভারতীয় পুরুষদের কদর ছিল বেশ। তাদের বিয়ে করার এক ধরনের আকুতিও নাকি ছিল । অবশ্য তিনি সে খপ্পরে পড়েননি। আয় রোজগার ভাল। ব্যাচেলর মানুষ। কিছু টাকা জমিয়ে একটা গাড়িও নাকি কিনেছিলেন। ট্যাক্সি হিসেবে চলত। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। জাপানীদের হাতে সিঙ্গাপুর পতনের পর ১৯৪২ সালে বর্মার পতন হলো। বাবা বলতেন বার্মিজরা সম্ভবত এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিল। প্রথম সুযোগেই জাপানী সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে শুরু করে দিল ভয়াবহ দাঙ্গা। এটি ছিল ভারতীয়দের বর্মা থেকে উৎখাত করার দাঙ্গা। বাবা হাজার হাজার ভারতীয়ের সঙ্গে এককাপড়ে হেঁটে রওনা দিলেন দেশের উদ্দেশ্যে। প্রায় একমাস চলার পর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় চট্টগ্রাম পৌঁছেছিলেন। পথে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
বর্মায় বর্ণ এবং জাতিবিদ্বেষ এখনও প্রকটভাবে বিদ্যমান। অথচ এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্পূর্ণ নীরব। বর্মায় বসবাসরত নাগরিকদের দু’ধরনের পরিচয়পত্র দেয়া হয়। একটি লাল রং-এর অন্যটি সাদা। লালটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বার্মিজদের। অন্যটি সাদা, পেছনে লেখা থাকে এই কার্ডধারী বর্মার নাগরিক নয়। রোহিঙ্গাদের কার্ডের পেছনে লেখা থাকে; এর বাহক একজন বাঙালী মুসলমান। এটি একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার যে একবিংশ শতকে এসেও নাৎসি জার্মানির একটি মডেল রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নিয়েছে এবং ইদানীং সকলে মিয়ানমারের নতুন সরকারকে হাত কচলে বেশ খোশামোদ করছে।
উত্তর আরাকান প্রদেশ বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা। এখানকার রোহিঙ্গারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের হাতেই সর্বাধিক নিগৃহীত হয়। এদের বিয়ে করতে হলে প্রশাসন থেকে পূর্বানুমতি নিতে হয়, যা সচরাচর মিলে না। বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না। রোহিঙ্গাদের এখান হতে অন্য প্রদেশে যাওয়া বেআইনী। মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশ বাহিনীতে কোন রোহিঙ্গা মুসলমানের চাকরি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। স্থানীয় রাখাইনরা সুযোগ পেলেই দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু করে। এসবের কোন বিচার কখনও হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরাকান রাজ্যে প্রথম বড় ধরনের দাঙ্গা হয় ১৯৬২ সালে। তখন কয়েক হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু কক্সবাজার হয়ে চট্টগ্রাম প্রবেশ করে। কয়েক হাজার থাইল্যান্ডেও চলে যায়। সে সময় যারা চট্টগ্রামে এসেছিল পরবর্তীকালে তারা এখানকার মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ভিটামাটি হতে উচ্ছেদ হয়ে রোহিঙ্গাদের প্রথম অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৭৮ এবং ১৯৭৯ সালে যখন আরাকানে বর্মার সেনাবাহিনী অপারেশন ‘নাগামিন’ নামে একটি জাতিগত শুদ্ধি অভিযান শুরু করে। সে ধাক্কায় বাংলাদেশে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সমস্যাটির কোন কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা না করে নাফ নদীতে নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ পাঠায়। সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। পাল্টা বর্মাও একই কাজ করে। কিন্তু সমস্যা সমস্যাই থেকে যায়। আরেকটি ধাক্কা আসে ১৯৯০-৯১ সালে যখন প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার এমন অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ করার জন্য একটি দেশও বাংলাদেশের পাশে কার্যকরভাবে দাঁড়ায়নি। শুধু জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা কিছু রিলিফসামগ্রী নিয়ে কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া, কুতুপালং প্রভৃতি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে তাদের পাশে দাঁড়ায় তবে তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বর্তমানে সরকারীভাবে দু’টি শরণার্থী শিবির আছে। বাংলাদেশ মাঝে মাঝে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সে দেশে ফেরত পাঠাতে কয়েকবার চেষ্টা করেও তেমন একটা সফল হয়নি। তারা শুধু কয়েক হাজার শরণার্থীকে ফিরিয়ে নিয়ে সাফ জানিয়ে দেয়Ñ বাকিরা তাদের দেশের নাগরিক নয়। বাংলাদেশের মতো একটা দেশের পক্ষে সম্ভব নয় কয়েক লাখ শরণার্থীকে বছরের পর বছর চারদিকে তারকাঁটার বেড়া দিয়ে আটক করে রাখা। বর্তমানে দুই ক্যাম্পে শুধু ত্রিশ হাজারের মতো তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা আছে বাকিরা দেশের জনারণ্যে মিশে গেছে এবং বিভিন্ন সময় তারা একশ্রেণীর দালাল আর অসাধু সরকারী কর্মকর্তাদের সহায়তায় বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে শুধু চলেই যায়নি সেসব দেশে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের সুনামের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে তাদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশে মাদক ব্যবসা এবং নারী ও শিশু পাচারসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে কয়েক শ’ রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম শহরে চলে এসেছে। চট্টগ্রাম এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের চারপাশের সকল খালি জায়গা ইতোমধ্যে তাদের দখলে চলে গেছে। এলাকাটি হয়ে পড়েছে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। তবে সব চাইতে যেটি ভয়াবহ সমস্যা এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো এখন জঙ্গী তৈরির প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এদের নিয়ে গোপনে কাজ করে সৌদি আরবভিত্তিক রাবিতাত আল ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, হেফাজতে ইসলামসহ অনেক ধর্মান্ধ মৌলবাদী দল ও জঙ্গীবাদী সংগঠন।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সবচাইতে হতাশাজনক ভূমিকা পালন করেছে গণতন্ত্রের মানসকন্যা খ্যাত আউন সান সুচি। এ ব্যাপারে তার কোন কার্যকর ভূমিকা চোখে পড়ে না। সম্প্রতি তিনি অসলোতে একুশ বছর পূর্বে তাকে প্রদত্ত শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার নিতে গিয়ে তাঁর বক্তৃতায় বলেনÑপ্রবাসী বার্মিজরা মিয়ানমারে সকল নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মাঝে শান্তি ফিরিয়ে আনতে গুরুপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যস, ওটুকুই ।
সম্প্রতি নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রবেশকে কেন্দ্র করে নানা বিতর্কের জন্ম হয়েছে। সরকার নতুন করে কোন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দিতে নারাজ। সার্বিক বিচারে এটি সরকারের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে অনেকে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, সরকারের উচিত আরও একটু মানবিক হওয়া। এই প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট কয়েক ব্যক্তি ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েছেন। জামায়াত-বিএনপি বলেছে, সরকারের উচিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া। একজন সিনিয়র সাংবাদিক কলাম লিখে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের যেন আবার বাঘের মুখে ঠেলে দেয়া না হয়। সরকারী দলের এক সংসদ সদস্য পত্রিকায় মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে বলেছেনÑরোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখে তার রাতে ঘুম হয় না। জাতিসংঘ আর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে। জামায়াত আর বিএনপির বলার মধ্যে একটা বড় বদমতলব আছে। বিএনপি আমলে এই রোহিঙ্গাদের অনেকেই ভোটার হয়েছে। সে ভোট তাদের বাক্সে পড়বে। তাদের আমলেই সবচাইতে বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গেছে। জামায়াত ও সমমনা দল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এদেরকে তাদের জিহাদী আর সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করবে। এদের প্রতি আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায়ের জন্য এরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কার বিখ্যাত মাইলাই গণহত্যার একটি ছবি তারা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ছবি বলে ইন্টারনেটে আপলোড করেছে। অন্য আর একটি ছবি আছে যেটি আসলে থাই পুলিশের হাতে ধৃত গোটাপঞ্চাশেক রোহিঙ্গার। পুলিশ তাদের সমুদ্রের বালিতে উপুড় করে শুয়ে রেখেছে। কিন্তু ছবির ক্যাপসান দেয়া আছে বর্মার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মেরে ফেলে রেখেছে। টেকনাফে এখন কিছু মোবাইল ফোনের দোকানে কিছু হিন্দী ছবির নির্যাতনের দৃশ্যের ক্লিপিং পাওয়া যায় যা রোহিঙ্গা নির্যাতনের ছবি হিসেবে মোবাইলে ডাউনলোড করে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এটি সত্য, সাম্প্রতিক দাঙ্গায় অনেক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে, অনেক নারী ধর্ষিত হয়েছে। তবে এই ছবিগুলোর কোনটাই সে সবের নয়। টেকনাফ আর কক্সবাজারে জামায়াতের নেটওয়ার্ক বেশ শক্তিশালী। শোনা যায়, অনেক রোহিঙ্গা গোপনে জামায়াতীদের বাড়িতেও আশ্রয় নিয়েছে। পুরো এলাকা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার দাবি সংবলিত পোস্টারে ছেয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা এখানে নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব এলাকার দিনমজুরদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ দানা বাঁধছে। কারণ যেখানে একজন দিনমজুরের দৈনিক পারিশ্রমিক দেড় থেকে দুই শ’ টাকা সেখানে একজন রোহিঙ্গা শ্রমিক পাওয়া যায় পঞ্চাশ টাকা দিয়ে। যাঁরা মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে বলেন তাঁরা এখানকার বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত নন। বাংলাদেশ অতীতে সব সময় মানবিক আচরণ করেছে, এখনও করছে। কিন্তু তাতে ফলাফল শূন্য। এ সম্পর্কে আমাদের বিশিষ্টজনরা একেবারেই নিশ্চুপ।
কেউ কেউ অনেকটা অর্বাচীনের মতো রোহিঙ্গাদের সমস্যাকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেন। একাত্তর সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করছিলাম। সেই যুদ্ধে এক কোটি বাঙালী শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমরা একটা প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলাম। শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তারা যাতে নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যায় সে চেষ্টা করেছিল ভারত। যুদ্ধ শেষে দ্রুততম সময়ে প্রত্যেক বাংলাদেশী নিজ দেশে ফিরে এসেছিলেন। ভারতে থেকে গিয়েছে তেমন বাঙালী হাতে গোনা যায়। একাত্তরের বাংলাদেশের শরণার্থীদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের তুলনা করা চরম মূর্খতার শামিল।
এটি ঠিক মিয়ানমার বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। তাদের সঙ্গে আমাদের অনেক অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। তবুও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ চুপ থাকতে পারে না। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহল থেকে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য সকল ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। প্রয়োজনে বিষয়টা জাতিসংঘের নজরে আনতে হবে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা ভারত তেমন কিছু করবে বলে মনে হয় না। কারণ নতুন মিয়ানমারের অফুরন্ত সম্পদ ও সম্ভাবনার দিকে এখন তাদের সকলের লোলুপ দৃষ্টি। সকলে নিজের স্বার্থ রক্ষাকে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দেয়। কিছুদিনের মধ্যে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে। বাংলাদেশকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করার বিষয়ে নিশ্চয় আলাপ হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার মতো একটি সমস্যা জিইয়ে রেখে কোন সম্পর্কই যে কার্যকর হবে না তা তাকে বুঝতে দিতে হবে। বাংলাদেশ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সমস্যার মীমাংসা করেছে। এই সমস্যারও সমাধান হবে, তা মানুষ আশা করতেই পারে। এটি যত না গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য তার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মিয়ানমারের জন্য। এর ব্যত্যয় ঘটলে একটি নতুন গণতান্ত্রিক মিয়ানমারের অভ্যুদয় অধরাই থেকে যাবে।
বিএনপি-জামায়াতের কথা বাদ দিলাম। বাকি যাঁরা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে ওকালতি করছেন তাঁদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছিÑবাস্তবতাটা উপলব্ধি করুন, নিজের দেশের স্বার্থটাকে সবার ওপর স্থান দিন। এখনও বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণ রোহিঙ্গাদের প্রতি অনেক মানবিক আচরণ করছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক। জুন ২২, ২০১২